সাইকেল চালাতে জানেন না, এমন বাঙালির সংখ্যা নিতান্তই হাতে গোনা। একটা সময় বাংলা তো বটেই, ভারতের অন্যতম যাতায়াতের মাধ্যম ছিল সাইকেল। তবে অর্থনৈতিক উন্নতি এবং প্রযুক্তির দৌলতে আজকের প্রজন্ম ক্রমশ দূরে সরছে বাইসাইকেলের থেকে, আপন করে নিচ্ছে মোটরবাইক কিংবা গাড়িকে। তবে কোভিড মহামারীর সময় পরিস্থিতির চাপে পড়ে সাধারণ মানুষ আবার ফিরে গিয়েছিলেন পুরনো দিনে, সাইকেলে। এমনকি সাইকেল (Cycle) ব্যবহারের করার জন্য অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল সরকারও। কিন্তু খোদ প্রধানমন্ত্রীই যদি প্রতিদিন বাড়ি থেকে সাইকেলে চেপে অফিসে যাওয়া শুরু করতেন?
তা আবার হয় নাকি? সেক্ষেত্রে তাঁর নিরাপত্তার কী হবে? বিষয়টা হাস্যকর লাগলেও, এমনই দৃশ্য দেখা যায় নেদারল্যান্ডসে (Netherlands)। সাধারণ মানুষই হোক কিংবা কোনো বড়ো রাজনৈতিক নেতা— সাইকেলে চেপে অফিসে যাওয়া সে-দেশে পরিণত হয়েছে এক ঐতিহ্যে। সাইকেল না-চালাতে পারাটা সেখানে লজ্জাজনক ‘অপরাধ’। কিন্তু কীভাবে সাইক্লিস্টদের ‘ইউটোপিয়া’ হয়ে উঠল নেদারল্যান্ডস?
নেদারল্যান্ডসে প্রথম সাইকেলের চল শুরু হয় ১৯২০ সাল নাগাদ। মূলত বিশ্বযুদ্ধের পর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরও একধাক্কায় বৃদ্ধি পেয়েছিল সাইকেলের ব্যবহার। তবে সময় যত গড়িয়েছে, যত দৃঢ় হয়েছে দেশের অর্থনীতি, মানুষের হাতে এসেছে খরচ করার সামর্থ্য, ততই পাল্লা দিয়ে কমেছে সাইকেলের ব্যবহার। বাইসাইকেল থেকে সরে গিয়ে সাধারণ মানুষ ঝুঁকেছে মোটরগাড়ি ও বাইকের দিকে। পরিসংখ্যান বলছে, ষাটের দশকে প্রতি ৫ জন ওলন্দাজ নাগরিকের মধ্যে একজনের কাছে মালিকানায় থাকত একটি করে গাড়ি। অর্থাৎ, সে-যুগে গাড়ি ছিল প্রায় সমস্ত মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত ওলন্দাজ পরিবারে।
অবশ্য প্রাণ দিয়েই এই ‘উন্নয়ন’-এর মূল্য দিতে হয়েছিল ওলন্দাজদের। হ্যাঁ, ১৯৭১ সালে প্রকাশ্যে আসে এমনই এক আশ্চর্য তথ্য। শুধুমাত্র সে-বছরই নাকি নেদারল্যান্ডসে গাড়ি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ৩ হাজারের বেশি মানুষ। যার মধ্যে প্রায় ৫০০ জন শিশু। সংখ্যাটা বেশি মনে না-হলেও, তৎকালীন ওলন্দাজ জনসংখ্যার ভিত্তিতে কম নয় মোটেই। হিসেব অনুযায়ী, প্রতি ১৩০০০ মানুষের মধ্যে ৩ জন প্রাণ হারাতেন দুর্ঘটনায়।
এই ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলেন ওলন্দাজ সাংবাদিক ভিক ল্যাঙ্গেনহফের। উল্লেখ্য, গাড়ি দুর্ঘটনায় ১১ বছর বয়সি কন্যাকে হারিয়েছিলেন তিনি। সে-সময় দেশজুড়ে সাড়া ফেলে দেয় তাঁর লেখা প্রতিবেদন, ‘স্টপ ডি কিন্ডারমুর্ড’। যার বাংলা অর্থ হল ‘শিশুহত্যা বন্ধ হোক’। ভিকের এই ডাকে প্রশাসন তো বটেই সাড়া দিয়েছিলেন সাধারণ মানুষও। অনেকে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারে ইতি টেনে বেছে নিয়েছিলেন পাবলিক ট্রান্সপোর্ট। কেউ আবার ফিরে গিয়েছিলেন সাইকেলের যুগে। ডাচ সরকারও সাইকেলের ব্যবহার বাড়ানোর জন্য শুরু করেছিল একাধিক প্রচার, প্রকল্প। তৈরি হয়েছিল সাইক্লিস্টদের চলাচলের জন্য বিশেষ পরিকাঠামো, গ্যারেজ, পৃথক রাস্তা।
২০২১ সালের গণনা অনুযায়ী, বর্তমানে নেদারল্যান্ডসের ৪৫ শতাংশ মানুষ ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করলেও, ৩৬ শতাংশ মানুষের দৈনিক যাতায়াতের মাধ্যম সাইকেল। বাকি ১৯ শতাংশ মানুষ ব্যবহার করেন পাবলিক ট্রান্সপোর্ট। এমনকি নেদারল্যান্ডসে গোটা রেলপথের দৈর্ঘ্য যা, তার চেয়েও বেশি দৈর্ঘ্য সাইকেলে চেপেই অতিক্রম করেন ওলন্দাজরা। প্রতি সপ্তাহে রবিবার করে সাধারণভাবে ব্যবহৃত হয় না ব্যক্তিগত গাড়ি। এই দিনটা বরাদ্দ কেবলমাত্র সাইকেল এবং গণ-পরিবহনের জন্যই।
মজার বিষয় হল, শুধু দুর্ঘটনাই নয়, সাইকেল ব্যবহারের ফলে অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের তুলনায় দূষণের মাত্রাও অনেকাংশেই কম নেদারল্যান্ডসে। সেই সঙ্গে সাইকেল ব্যবহারের কারণে বার্ধক্যেও সুস্থসবল থেকেন ওলন্দাজরা। ২০১৫ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণা অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় হৃদরোগে ৬৫০০ মানুষের মৃত্যুর ঘটনা প্রতিরোধ করেছে সাইক্লিং-এর এই অভ্যাস। কমেছে ডায়াবেটিস ও রক্তচাপের মতো রোগের প্রকোপও। সবমিলিয়ে প্রযুক্তির থেকে দূরে সরে এসে যেন এক ঢিলে দুই পাখি মেরেছেন ওলন্দাজরা।
Powered by Froala Editor