করোনা-পরিস্থিতিতে ভারতে লকডাউনের সময়সীমা বাড়ানো হয়েছিল একাধিকবার। তবে এই লকডাউন দেশের শিল্পমহলের পক্ষে খুব একটা ভালো বার্তা নিয়ে হাজির হয়নি। লকডাউন সাময়িক ব্যাপার; কিন্তু এর ফলে যে অদ্ভুত একটা পরিস্থিতির মধ্যে এসে পড়েছি আমরা, সেটা তো কেউ অস্বীকার করতে পারবে না! সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে গিয়ে বাঁচতে হবে— এটাই তো এখনকার নিউ নর্মাল। করোনা অতিমারিতে অর্থনীতির ওপর যে প্রভাব পড়েছে তা আগামী বেশ কয়েক বছর বহাল থাকবে। কাজের জায়গায় চাপ বেড়ে যাওয়া, চাকরি চলে যাওয়া, মানসিক ট্রমা ইত্যাদি ব্যাপারগুলি থাকলেও, কোম্পানিগুলি টিকে থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছে। বলা ভালো, এটাই সঠিক সময় নিজেকে নতুন করে তৈরি করার, এবং আবারও ফিরে আসার…
আমাদের চারিদিকে সমস্তকিছুর সংজ্ঞা বদলে যাচ্ছে। কাজের পরিবেশও বদলাবে। সংস্থার কর্মী থেকে শুরু করে ম্যানেজার, হিউম্যান রিসোর্স টিম— সবাইকে বোঝা দরকার যে, পুরনো সিস্টেমে আর সাফল্য আসবে না। এতদিন যা বেদবাক্য বলে মেনে নেওয়া হত, সেসব আজকে বদলে যেতে বাধ্য। সেইজন্যই তো ‘নিউ নর্মাল’! এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আমাদের প্রত্যেকেরই নিজের নিজের চাকরি নিয়ে প্রবল দুশ্চিন্তা রয়েছে। জীবনের প্রতিটি পদে আমরা ভেঙে পড়ছি, মানসিক চাপ ও বিষণ্ণতা (ডিপ্রেশন) গ্রাস করছে। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে একজন নিয়োগকর্তা ও কর্মচারীর মধ্যের সম্পর্ককে হতে হবে মিথোজীবীর মতো। এখন একজন কর্মীর যে কোনো সুযোগকে নিজের কাজে লাগাতে হবে, এবং এইভাবেই টিকে থাকতে হবে। কিন্তু একটা কোম্পানির সাফল্যের পেছনে কর্মী ও কর্তা দুজনেরই সমান অবদান। কাজের সুবিধার জন্য এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যাতে একজনের কাজ করতে অসুবিধা না হয়, চাপ না লাগে।
এবার আমরা অ্যাপ্লায়েড সাইকোলজির দুটো গুরুত্বপূর্ণ ফ্রেমওয়ার্কের দিকে নজর দিই। প্রথমটি হল ‘ডিমান্ড/কন্ট্রোল মডেল’। গবেষণা বলে, যেখানে ডিমান্ড বা চাহিদার জায়গাটি বেশ স্বাস্থ্যকর এবং ভালোভাবে বজায় রাখা হয়; এবং চাপের পরিবেশ থাকলেও কর্মীর সেই কাজে কন্ট্রোল বা নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকে সেটাই ‘অ্যাকটিভ’ বা সক্রিয় কাজ। উল্টোদিকে, ‘রিল্যাক্সড’ হল সেটা, যেখানে কাজে চাহিদার পরিমাণ অনেক কম, এবং সেই কারণে নিয়ন্ত্রণও অনেকটা বেশি। আপাতদৃষ্টিতে ভালো বলে মনে হলেও, এতে কর্মীর ভেতর থেকে কোনো তাগিদ আসে না। আর যেখানে চাহিদা আকাশছোঁয়া, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ খুবই কম— এমন কাজকে বলে ‘হাই স্ট্রেইন’। এখানে সমস্যাটা হল, একটা সময় পর কাজে অংশ নেওয়া ব্যক্তিটির নিজের দক্ষতা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয় এবং একটা অসহায়তা তৈরি হয়। কাজের চাপ তাঁকে ভেতরে ভেতরে কুরে খেয়ে ফেলে। আর শেষে আছে ‘প্যাসিভ’ কাজ; যেখানে চাহিদা ও নিয়ন্ত্রণ দুটোই এত কম যে উন্নতি করার জায়গা নেই। এবং এখানেও একটা পর্যায়ের পর হতাশা আসে, অসহায় লাগে।
এবার ব্যাপারটি হল, চাকরি বা কাজের ওপর নিয়ন্ত্রণ যত ভালো হবে, ততই নিজের কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা যাবে। আর এটি থাকলে হতাশাও একটু একটু করে কমে যায়। এর উল্টোটা হলেই সর্বনাশ। কোভিডের এই পরিস্থিতিতে, যেখানে প্রত্যেকে আবার নতুন করে ট্র্যাকে ফিরতে চাইছে, সেখানে অ্যাকটিভ কাজই যে তাঁদের তালিকায় প্রথমে থাকবে, এমনটা ভাবার কারণ নেই। রিল্যাক্সড আর প্যাসিভ কাজেও চাপ বাড়বে, অন্যান্য অনেক কিছু আসবে। তবে এমন বিপদের সময়, কাজের পুরো ঢেউটাই চলে যাবে ‘হাই স্ট্রেইন’-এর দিকে। মানে, কাজের চাপ আরও বাড়ছে, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ সেরকম নেই। ফলে বাড়ছে চাপ, উদ্বেগ, হতাশা। আর এই পুরো বিষয়টা একবার শুরু হলে অবধারিতভাবে কাজের ওপর প্রভাব পড়বে। সেটা যে ভালো কিছু নয়, তা বলাই বাহুল্য।
এবার রোল-বেসড মডেলের দিকে একটু তাকানো যাক। এর তিনটে বৈশিষ্ট্য আছে, যা একজন কর্মীর অভিজ্ঞতাকে দর্শায়— রোল লোড বা দায়িত্ব, রোল ক্ল্যারিটি বা স্বচ্ছতা, এবং রোল এগ্রিমেন্ট বা চুক্তি। গবেষকরা বলছেন, কাজে নির্দিষ্ট কিছু চাহিদা যদি থাকে, এবং কাজটি যদি চ্যালেঞ্জিং কিন্তু সামলে নেওয়া যায়, তাহলে সেটা একজন কর্মীর মনোবলের ওপর প্রভাব ফেলে।
এবার এই তিনটি বৈশিষ্ট্যের দিকে একঝলক তাকালে বোঝা যায়, কাজের চাপ ও দায়িত্বের সঙ্গে শরীর-স্বাস্থ্য, ভালো মেজাজের একটা স্পষ্ট সম্পর্ক আছে। যদিও এটা বলা যায় ভবিষ্যতে একটা বড়ো সংখ্যক চাকরির অভিমুখ ‘অ্যাকটিভ-হাই স্ট্রেইন’-এর দিকে বাঁক নেবে। তাহলে সবকিছু মাথায় রেখেও যাতে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়, সেজন্য কীভাবে কাজের জায়গার বদল আনা প্রয়োজন? রোল লোডকে আমরা ওয়ার্কলোড বা কাজের দায়িত্ব হিসেবে বর্ণনা করতেই পারি। এবার প্রথম বিষয়, এখনকার অর্থনীতি যেভাবে নিচের দিকে যাচ্ছে সেটা বাজারে প্রভাব ফেলবে। দ্বিতীয় বিষয়, অনেক ব্যবসাই এই মুহূর্তে বেশ খারাপ জায়গায় আছে। এবং এই জায়গায় দাঁড়িয়ে তারাও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবে। তাহলে কি সমস্ত জায়গাতেই কাজের চাপ বাড়বে, নাকি কয়েকটি বিভাগে? একটা নির্দিষ্ট ডিপার্টমেন্টে কার সহনশীলতা বেশি, শেখার ইচ্ছা বেশি সেটা একজন ম্যানেজার বা কর্মকর্তা কীভাবে বুঝবেন? ঠিক এইখানেই কর্মীদের ব্যক্তিগত প্রোফাইলিং গুরুত্বপূর্ণ, এবং এই কাজটি মুশকিলও বটে।
আরও পড়ুন
অফিসের ফাঁকে তেলেভাজা? মেদ বাড়ছে কর্পোরেটদের
কোভিডের এমন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে চাকরি বাঁচানোটাই এখন বড়ো ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেখানে কর্মীর নিজের সুবিধা সুযোগ নিয়ে আলাপ-আলোচনার পরিবেশটাই একদম কমে গেছে। এত কিছুর মধ্যেও ভালো উৎপাদন, পণ্যের জোগান এবং কর্মীদের ভালোভাবে রাখার ব্যাপারটি ভাবা যেতে পারে। গবেষণা বলে, কাজের প্রতি নিশ্চয়তা, সন্তুষ্টি ও দায়বদ্ধতা নির্ভর করে রোল ক্ল্যারিটির ওপর। এতে কাজের জায়গায় স্ট্রেস, উদ্বেগ, মানসিক অস্থিরতা কমে, এবং কাজের পরিবেশও ভালো হয়। এইদিকেই এখন সবার নজর দেওয়া উচিত।
Powered by Froala Editor