নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু তাঁকে আখ্যা দিয়েছিলেন ‘জাতির জনক’। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘মহাত্মা’। ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর নাম। অহিংসার মাধ্যমে স্বাধীনতা আন্দোলনের যে তিনি পথ গ্রহণ করেছিলেন, পরবর্তীতে তাকে অনুসরণ করেছে বহু দেশ। সারা বিশ্বে তাঁর জন্মদিন ২ অক্টোবর পালন করা হয় ‘অহিংস দিবস’ রূপে। তাঁর আদর্শ অনুসরণ করেছিলেন আমেরিকার জন-অধিকার আন্দোলনের মূল উদ্যোক্তা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের নেতা অ্যালবার্ট লুথলি। দুজনেই পেয়েছিলেন নোবেল শান্তি পুরস্কার (Nobel peace Prize)। অথচ পুরস্কার প্রাপকদের তালিকায় নেই মহাত্মা গান্ধীর (Mahatma Gandhi) নাম। কারণটা কী? তৃতীয় বিশ্বের নাগরিক বলেই কি বঞ্চনার শিকার হতে হয়েছিল তাঁকে, নাকি অন্য কোনো ইতিহাস জড়িয়ে এর সঙ্গে?
নোবেল শান্তি পুরস্কারের মনোনয়নে গান্ধীজির নাম উঠেছিল পাঁচবার। ১৯৩৭, ১৯৩৮, ১৯৩৯, ১৯৪৭ সালে এবং তাঁর মৃত্যুর ঠিক কিছুদিন আগে, ১৯৪৮ সালে। তিনের দশকেই গান্ধীজি ও তাঁর নীতি সারা বিশ্বে প্রবল জনপ্রিয়তা পায়। ফলে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্রিকা থেকে তাঁকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়ার দাবি জোরদার হতে থাকে। ১৯৩৭-এ নরওয়ের লেবার পার্টির ওলে কল্বজর্নসেনের (Ole Colbjornsen) বকলমে ‘ভারতের বন্ধু’-রা (Friends of India) মনোনীত করেন গান্ধীজির নাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাননি সেই পুরস্কার। তাহলে কি ইংল্যান্ডের সঙ্গে সুসম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাওয়া নিয়ে ভয় পেয়েছিল নোবেল কমিটি? ১৯৩৮ ও ১৯৩৯-এ আবার তাঁকে মনোনীত করলেন কল্বজর্নসেন। কিন্তু শেষ বাছাইয়ে পৌঁছোয়নি তাঁর নাম। ফলে নোবেলপ্রাপ্তি অধরা রইল এবারও।
আসলে নোবেল কমিটি ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি তাঁকে কোন বিভাগে রাখা যায়। তথাকথিত রাজনৈতিক নেতার তালিকায় তখন আর তাঁকে রাখা যায় না। জাতীয় কংগ্রেসের কেন্দ্রবিন্দু থেকে অনেকটা সরে এসে তিনি মন দিয়েছেন হরিজন কল্যাণের কাজে। স্বাধীনতা সংগ্রামী ঠিকই, কিন্তু সাধারণ মানুষ তাঁকে দেখে দেবতার চোখে। নিজেও অস্বীকার করেন না সেই তকমা। আবার কখনও-বা সাধারণ রাজনৈতিক নেতার মতো একাধিক স্পর্শকাতর সিদ্ধান্ত নেন, যা নিয়ে দানা বাঁধতে পারে বিতর্ক। তিনি জাতীয়তাবাদী, কখনও বা ‘একনায়কবাদী’। কোনো আন্তর্জাতিক শান্তি আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। সবচেয়ে বড়ো কথা, অহিংসা, শান্তির পাশাপাশি মানুষের নৈতিক চরিত্র সংশোধনেও তিনি তৎপর। যার ফল হতে পারে সুদূরপ্রসারী, দুয়েক বছরের কাজের নিরিখে যার মূল্যায়ন করা মুশকিল। সব মিলিয়ে গান্ধীজিকে নিয়ে দ্বিধায় ছিল নোবেল কমিটি।
অবশেষে এল ১৯৪৭ সাল। গত দশ বছরে অনেক উত্থানপতনের সাক্ষী থেকেছে ভারত। দেশ স্বাধীন হল দাঙ্গা আর উদ্বাস্তু স্রোতে পা ভিজিয়ে। ভালো-মন্দ উভয়ভাবেই জড়িয়ে আছে গান্ধীজির নাম। দাঙ্গাবিধ্বস্ত নোয়াখালি, পাটনা, কলকাতায় উপস্থিত থেকে চেষ্টা করেছেন সাম্প্রদায়িকতা বন্ধ করতে। এবারও তাঁর নাম মনোনীত হল সম্ভাব্য নোবেলপ্রাপকদের তালিকায়। নোবেল কমিটির পক্ষ থেকে জেনস আরুপ সেইপের (Jens Arup Seip) রিপোর্টে বলা হল, গান্ধীজির উপস্থিতি ও অহিংসা মতবাদ আরো বড়ো রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার হাত থেকে বাঁচিয়েছে দুই দেশকে। কিন্তু মতবিরোধ তৈরি হল পাকিস্তানের সঙ্গে ‘যুদ্ধ’-এর বিষয়টি নিয়ে। যিনি আজীবন অস্ত্রপ্রয়োগের বিরোধিতা করেছেন, তিনি কিনা শেষপর্যন্ত সহমত প্রকাশ করলেন কাশ্মীর প্রসঙ্গে সেনাবাহিনীর সাহায্য নেওয়ার বিষয়ে! গান্ধীজি অবশ্য রিপোর্টটি সংশোধন করার জন্য নিজের যুক্তি রেখেছিলেন। কিন্তু নোবেল কমিটির পক্ষে তা যথেষ্ট ছিল না।
আরও পড়ুন
ব্রাজিলের ক্লাবে ফুটবল খেলেন মহাত্মা গান্ধী!
১৯৪৮-এর ২ ফেব্রুয়ারি ধার্য করা হয়েছিল নোবেল কমিটির মনোনয়ন করার শেষ তারিখ। আর ৩০ জানুয়ারি নাথুরাম গডসের গুলিতে মারা গেলেন গান্ধীজি। তার আগে পর্যন্ত চালু ছিল না মরণোত্তর নোবেল দেওয়ার প্রথা। কিন্তু ঘটনাবিশেষে সে নিয়ম বদলানোর স্বাধীনতাও ছিল তাদের হাতে। এবার প্রায় প্রত্যেকেই সহমত জানালেন গান্ধীজির নোবেল পাওয়া নিয়ে। কিন্তু দেবেন কীভাবে? তাঁর নিজস্ব কোনো সংগঠন নেই, কোনো উইল নেই। আবার নিয়মের গেরোয় বাধা পড়লেন তাঁরা। শেষে তাঁকে সম্মান জানাতে সেবার মুলতুবি রাখা হল নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান। কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হল— “There was no suitable living candidate.”
আরও পড়ুন
গান্ধীজির হাতেই প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম ফুটবল ক্লাব!
নিজেদের স্বপক্ষে তাঁরা যা যুক্তি দিক না কেন, প্রশ্ন তো ওঠেই যে নিয়মের বজ্রআঁটুনি কি আলগা করা যেত না? অবশ্য এসব প্রশ্নের বহু ঊর্ধ্বে আজ তিনি। নিজেও এই নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন বলে জানা নেই। নোবেল পুরস্কার পেলে তাঁর মুকুটে আরেকটি পালক জুড়ত নিশ্চয়ই। কিন্তু দেশবিদেশে তাঁর আদর্শ যেভাবে মানবমুক্তির নতুন পথ খুলে দিয়েছিল, সেটাই সম্ভবত তাঁর কাছে সবচেয়ে বড়ো সম্মানের।
ঋণস্বীকার : Nobelprize.org
Powered by Froala Editor