ছোট্ট ঘরের ভেতর টিমটিম করে জ্বলছে আলো। সেখানে বসে একমনে মাটি মাখছেন একজন; একটু একটু করে পড়ছে গঙ্গাজল, ধানের শিষ, খড়, তুষ, গোবর, গো-চোনা ইত্যাদি। কিন্তু গঙ্গার বুকের এঁটেল মাটি এলেই দুর্গাপ্রতিমা গড়ার কাজ শুরু হয়ে যায় না। কুমোরপাড়া থেকে খবর যায় ‘সেইসব’ জায়গায়। যাকে সাধারণ মানুষ ‘পতিতাপল্লী’ হিসেবে চিনতেই ভালোবাসে।
প্রশ্ন ওঠে, দুর্গামূর্তি তৈরি করার আগে তাঁদের কাছে খবর যায় কেন? কেন তাঁদের দরজার বা উঠোনের মাটি নিয়ে প্রতিমা গড়া হয়? কারণটি লুকিয়ে আছে সেই শাস্ত্রেই। পতিতালয়ের উঠোনের মাটি না পেলে যে দেবীমূর্তি সম্পূর্ণ হবেন না! শাস্ত্র বলে, প্রতিমা তৈরির আগে ‘নবকন্যা’র উঠোনের মাটি মেশাতে হয় গঙ্গামাটির সঙ্গে। তারপর অন্যান্য জিনিস মিশিয়ে শুরু হয় প্রতিমা তৈরির কাজ। এই নবকন্যারই নবমজন হলেন ‘পতিতা’, অর্থাৎ যৌনকর্মী।
কিন্তু কেন এই প্রথা? কেন নবকন্যাদের মধ্যে জায়গা পেল সমাজের তথাকথিত ‘অচ্ছুৎ’রা? আজ থেকে তো নয়, সেই প্রাচীন সময় থেকেই দুর্গাপ্রতিমা তৈরির ক্ষেত্রে পতিতালয়ের মাটি ব্যবহার করা হয়। এমনকি, শাস্ত্রের পরতে পরতেও এর উল্লেখ আছে। এর একটি অন্য দিকের কথাও উল্লেখ করেছেন সমাজতাত্ত্বিকরা। তাঁদের মতে, সমাজের সকল স্তরের নারীশক্তিকে এক করার জন্যই এমন বিধান তৈরি করা হয়েছিল। যৌনকর্মী, সমাজ যাকে ‘পতিতা’ আখ্যা দিয়ে একঘরে সরিয়ে রেখেছে, তাঁরাও তো সেই শক্তির একটি আধার, সমাজের অংশ। কাজেই, নারীশক্তির আরাধনায় তাঁরা অংশ না নিলে কীভাবে সম্পন্ন হবে এই কাজ? শুধু তো যৌনকর্মীরাই নন; শূদ্রাণী, ধোপানী, ব্রাহ্মণী, নাপিতানিদের উঠোন বা দরজা থেকে মাটি এনে প্রতিমা গড়ার কাজে ব্যবহার করা হয়। ভালোভাবে দেখলে, সমাজের সমস্ত স্তরের বিভেদ মুছে এক করার একটা প্রয়াস শুরু হয়েছিল সেই প্রাচীন সময় থেকেই। সেই সূত্রেই ‘পতিতা’দের অন্তর্ভুক্তি…
শাস্ত্রে আরও একটা মতবাদও প্রচলিত। কোনো পুরুষ যখন যৌনকর্মীর ঘরে প্রবেশ করেন, তখন দরজার বাইরে, বা উঠোনে পড়ে থাকে তাঁর যাবতীয় পুণ্য। আর পুরুষের যাবতীয় কাম, লালসা গ্রহণ করেন যৌনকর্মীরা। এ তো একরকমের পুণ্যেরই কাজ! ঠিক এইভাবেই যেন নীলকণ্ঠ হয়ে ওঠেন সেই নারীরা। পুরুষের বিষ নিজের শরীরে গ্রহণ করে শুদ্ধ করে তোলেন বাকিদের। আর বাইরে পড়ে থাকা মাটি তাঁদেরই গুণে হয়ে ওঠে পবিত্র। সেটাই দুর্গাপ্রতিমার শরীরের অংশ হয়ে ওঠে। যাবতীয় সামাজিক অসুখ সরিয়ে এভাবেই যৌনকর্মীরা হয়ে ওঠেন দেবী। হয়ে ওঠেন নবকন্যাদের একজন…
অথচ কি আশ্চর্য দেখুন! এঁরাই সমাজের বুকে ব্রাত্য। এঁরা নাকি ‘অশুচি’, তাই পুজোর মধ্যে থাকাও বারণ। তাঁরা যে ‘নিষিদ্ধপল্লির’ বাসিন্দা। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকলে পাশ ফিরে, নাক কুঁচকে চলে যাওয়াই যে সমাজের ‘রীতি’! অথচ এই কথা বলতে বলতে আমরা ভুলে যাই পুরাণের কথা। ভুলে যাই দুর্গা প্রতিমার সৃষ্টির কথা। ভুলে যাই, কুমোরপাড়ায় প্রতিমা কীভাবে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠেন এই ‘পতিতা’দেরই বুকে নিয়ে। আর আধো অন্ধকারে, আমাদের যাবতীয় বিষ শুষে নেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে থাকেন সেই মানুষরাই। ঠিক যেন, দেবী…
তথ্যসূত্র –
১) ‘এই তিন উপাদান ছাড়া, বানানো হয় না মায়ের মৃণ্ময়ী মূর্তি’, দেবলীনা দত্ত দে, এশিয়ানেট নিউজ বাংলা
২) ‘কলকাতার যৌনপল্লীতে প্রথমবারের দুর্গাপুজো’, অমিতাভ ভট্টশালী, বিবিসি বাংলা
৩) ‘সমাজকে বিশুদ্ধ রাখতে সাহায্য করে এই ‘অশুদ্ধ’ বণিতারাই’, বিশাখা পাল, সংবাদ প্রতিদিন
আরও পড়ুন
পুজোতেও 'মেলা' নেই, আরও ঘোর অন্ধকারে মেলার দোকানিরা
Powered by Froala Editor