বিশ্বের সর্বত্র যত প্রাচীন মূর্তি ছড়িয়ে আছে, সেগুলি শুধু স্থাপত্যকীর্তির জন্য বিখ্যাত নয়। একই সঙ্গে এগুলি যেন বলে চলে ইতিহাসের কাহিনি। কয়েক হাজার বছরের ঘটনাবলির প্রত্যক্ষ নিদর্শন তারা। নিশ্চুপ থেকে সাক্ষ্য দেয় কত প্রাচীন তথ্যের। আশ্চর্যের বিষয় এই মূর্তিগুলির অধিকাংশের মধ্যেই চোখে পড়ে একটা সাধারণ মিল। না, প্রাচীনত্ব নয়। এদের অনেকেরই নাক ভাঙা। নিছক দুর্ঘটনা, নাকি কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য? আর বেছে বেছে কেন নাকই ভাঙা হয় মূর্তিগুলির?
একটা সহজ উত্তর হতে পারে বয়স। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভেঙ্গে গেছে নাক বা কানের অংশ। কিংবা বলা যেতে পারে, মূর্তিগুলি উদ্ধার করার সময় এই ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সেরকম দুয়েকটি ঘটনা হলে মেনে নেওয়া যেত, অথচ ইতিহাসের নমুনা বহনকারী অধিকাংশ মূর্তির ক্ষেত্রে একই ঘটনা উসকে দেয় অসংখ্য প্রশ্ন।
অনেক ইতিহাসবিদই এই নাক ভাঙার মধ্যে দেখতে পেয়েছেন অতীতের বিভিন্ন সংস্কারের ছায়া। মিশরের মতো প্রাচীন সভ্যতাগুলিতে যেমন মনে করা হত মূর্তিদের মধ্যেও ‘লাইফ ফোর্স’ আছে। অর্থাৎ তারাও প্রাণশক্তিতে বলীয়ান। সেভাবেই পূজা করা হত তাদের। ফলে যখনই বাইরের শত্রুর আক্রমণ ঘটত, তারা মূর্তির কোনো একটা অংশ ভেঙে দিত। যাতে সেই মূর্তির শক্তিকে নষ্ট করা যায়। আবার একটা মতে, দুর্যোগ-দুর্বিপাক ঘটলে ধরে নেওয়া হত মূর্তিদের মধ্যে ‘অপদেবতা’ ভর করেছে। সেই সুযোগ যাতে তারা না পায়, তাই আগেই শরীরের একটা অংশ ভেঙে দেওয়া হত।
কিন্তু নাক কেন? এক্ষেত্রেও ফিরে তাকাতে হবে মিশরীয়দের দিকে। তারা মনে করত, মানুষের মতো মূর্তিদেরও প্রাণশক্তি প্রবেশ করত নাকের মধ্যে দিয়ে। তাই প্রথম আঘাতটা পড়ত সেখানেই। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় স্ফিংসের মূর্তির কথা। হ্যাঁ, ‘অ্যাসটেরিক্স ও ক্লিওপেট্রা’ কমিকসে ওবেলিক্স যে বোকামি করেছিল, সেটাকে বাদ রেখেই বলা হচ্ছে। প্রচলিত মতে, ১৩৭৮ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ সাইম আল-দাহর ভেঙে দেন স্ফিংসের নাক। কারণ, স্থানীয় মানুষরা বিশ্বাস করত, এই মূর্তির সুবাদেই মরুদেশেও ফসলের কমতি পড়ে না। তাই চাষিরা নিয়মিত পূজা করত স্ফিংসকে। তাদের সর্বনাশ করার জন্যই নাক ভাঙার কাজ করেন আল-দাহর।
আরও পড়ুন
কলম্বাসকে সরিয়ে টুবম্যানের মূর্তি, কে তিনি?
একই সঙ্গে কান কাটা বা হাত ভাঙা মূর্তিদেরও অভাব নেই। এই প্রসঙ্গে ব্রুকলিন মিউজিয়ামের কিউরেটার এডওয়ার্ড ব্লেইবার্গের বক্তব্য, শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিশেষ অর্থ বহন করত প্রাচীন মিশরে। যেমন কান ভেঙে দেওয়ার অর্থ, মূর্তির দেবতা আর কোনো প্রার্থনা শুনতে পারবেন না। আবার বাঁ হাত ভেঙে দিলে তিনি আশীর্বাদ করার শক্তি হারাবেন। তবে, ব্লেইবার্গ এক্ষেত্রে সংস্কারের থেকেও বেশি গুরুত্ব আরোপ করেন রাজনৈতিক প্রশ্নে। মূর্তি ভাঙা আসলে সরাসরি আঘাত করে বিশ্বাসে। যা বুঝিয়ে দেয় বিপক্ষের শক্তিকে।
আরও পড়ুন
নারীমূর্তির চেয়ে জন্তুর মূর্তি বেশি লন্ডনের রাস্তায়!
যুগের পর যুগ ধরে অজস্র যুদ্ধবিগ্রহের সাক্ষী থেকেছে এই মূর্তিগুলি। নতুন শাসক আর তাদের নতুন বিশ্বাসে অনেকক্ষেত্রেই ভাঙা পড়েছে গোটা মূর্তি। কোথাও বা সম্পূর্ণ স্থাপত্য। শিল্পের ‘সমঝদার’ শাসকরা যেখানে সম্পূর্ণ মূর্তি ভাঙেনি, সেখানে শুধু ক্ষতি করেছে নাকের। শিল্পও রইল, ক্ষমতাও। আবার বিপরীত ঘটনা ঘটেছে অনেক স্থানে। রাজার অত্যাচারে বিক্ষুব্ধ মানুষ যখন ফেটে পড়তে চেয়েছে, তখন প্রাথমিক লক্ষ্য হয়েছে তাদের মূর্তি। প্রবল আক্রোশে ভেঙেছে মূর্তির বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্রে গুলতিতে ঢিল মেরে রাজার নাক ভাঙার দৃশ্য মনে পড়লেই কিন্তু প্রমাণ মিলবে এই যুক্তির।
নিউ ইয়র্কের সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক র্যাচেল কোউসার এই মূর্তি ভাঙার ইতিহাস খুঁজে দেখতে চান প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে। তাঁর মতে, মেসোপটেমিয়ান সভ্যতার রাজা সারগন অফ আক্কাদের মূর্তিটিই এই বিশেষ প্রথার প্রাচীনতম নিদর্শন। যার নাক ভাঙার পাশাপাশি কেটে দেওয়া দুটি কান। ক্ষতিগ্রস্ত করা হয় চোখের অংশটিও। যা নিশ্চিত করে সারগনের পতনের মর্মান্তিক কাহিনি। ঘটনা হচ্ছে, সেই ট্রাডিশন আজও সমানে চলছে। রাগ-ঘৃণার পাশাপাশি অশিক্ষা ও অন্ধত্বও একটা বড়ো কারণ। লিওনার্দো দি ভিঞ্চির ‘মোনালিসা’-র উপরেও আঘাত এসেছে একাধিকবার। কিংবা কিছুদিন আগে এই বাংলাতেই দেখা গেল শরৎচন্দ্রের মূর্তির গলায় দড়ি বাঁধা। অধিকাংশ সময়েই নোংরা-অপরিচ্ছন্ন হয়ে থাকে মনীষীদের মূর্তি। অতীতের মানুষ তো নাহয় কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে ভেঙেছে মূর্তির নাক। কিন্তু বর্তমানে সময়ে এই অবহেলায় ‘নিজের নাক কেটে’ কার যাত্রা ভঙ্গ করা হচ্ছে কেউ জানে না।
Powered by Froala Editor