মেয়েটি সুভাষবাবুর (Subhash Chandra Bose) কথা অনেক শুনেছিল, কিন্তু কখনও চোখের দেখা দেখেনি। একদিন রাত্তিরবেলা হঠাৎ করে মেয়েটির বাবা এসে মাকে বললেন, "সুভাষের সঙ্গে মিটিং-এ দেখা হল। খেতে বলে এসেছি, শিগগির রান্না তৈরি করো।" মেয়েটি তো ভেতরে ভেতরে আগ্রহে, উত্তেজনায় অধীর হয়ে উঠল৷ সুভাষবাবুকে প্রথম দেখার আনন্দ, সে একেবারে দিশেহারা অবস্থা তার! এর আগে তাঁর কথা কম শুনেছে!
সুভাষবাবু এলেন, খেতে বসলেন। এদিকে মেয়েটির দেখা নেই। কী যে হলো, হঠাৎ করে রাজ্যের লজ্জা আর সঙ্কোচ এসে ঘিরে ধরল তাকে। কেন কে জানে, ঘর থেকে কেউ তখন তাকে টেনে বার করতে পারছে না। শেষ অবধি অনেক ডাকাডাকিতে বেরিয়ে আসতেই হল। মা হাত ধরে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, "সুভাষ, আমার এই ছোটো মেয়েটি যে আবার তোমার মস্ত বড়ো ভক্ত।" মেয়েটির মনের মধ্যে তখন কী চলছিল, কে জানে!
সত্যিই, সেই মেয়ে সুভাষবাবুর অনেক বড়ো ভক্ত তো বটেই। সেই কাঁচা বয়সেই সে বুঝে গিয়েছিল, ভারতের স্বাধীনতা যদি আনতে হয়, তবে তার জন্য অস্ত্রের প্রয়োগ লাগবে, কেবল আবেদন-নিবেদনে কাজ হবে না। তাই তো, ১৯৩২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে বাংলার গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনের দিকে পরপর পাঁচবার গুলি চালানোর মতো দুঃসাহসিক কাজটা সে করেই ফেলল। আর, ফল হল দীর্ঘ কারাবাস।
হাসিমুখে কারাবরণ করলেন বীণা দাশ (Bina Das), বেণীমাধব দাশের ছোটো মেয়ে।
আরও পড়ুন
উদ্বোধন করেছিলেন খোদ সুভাষচন্দ্র, ধ্বংসের পথে বাঙালির প্রথম সিনেমা হল ‘মিত্রা’
ছোটোবেলা থেকে বীণা সুভাষবাবুর গল্প শুনতে শুনতেই বড়ো হয়েছেন। সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন বীণার বাবা বেণীমাধববাবুর সবচেয়ে প্রিয় ছাত্র। আই.সি.এস. ছেড়ে দেবার আগে মাস্টারমশায়কে চিঠি লিখে সম্মতি চেয়েছিলেন সুভাষ। বীণা দেখেছিলেন, তাঁর মায়ের বাক্সে সযত্নে রাখা চিঠিতে মাস্টারমশায়কে নিয়ে সুভাষের উচ্ছ্বাসোক্তি— "আপনার সঙ্গে আমার যা সম্বন্ধ তা এ জীবনে যাবে না। নইলে নিদ্রায় আপনাকেই স্বপ্ন দেখি কেন? জাগ্রতে আপনার মূর্তি ধ্যান করি কেন?" বাবার কাছে শোনা সুভাষবাবুর গল্প কিশোরী বীণা শতখানা করে বন্ধুদের কাছে বলতেন, আর শপথ নিতেন, "আমরাও ভাই এইরকম হব।"
আরও পড়ুন
‘আমার কারোর থেকে উপদেশ নেওয়ার প্রয়োজন নেই’, হিটলারকে জবাব সুভাষচন্দ্রের
বাংলাদেশে যখন ছাত্র আন্দোলন প্রবল হয়ে উঠল, তখন ছাত্রীরাও তাতে যোগ দিতে আরম্ভ করলেন। ছাত্রীসংঘে নাম লেখালেন বীণা। এইসময় একদিন আবার তাঁদের বাড়ি এলেন সুভাষবাবু৷ তখন মুগ্ধার সঙ্কোচ কেটে গেছে, অনেকক্ষণ ধরে গল্প হলো সুভাষ আর বীণার। হঠাৎ বীণা প্রশ্ন করলেন, "আচ্ছা, আপনার কী মনে হয়, কীভাবে দেশ স্বাধীন হবে— হিংসার পথে না অহিংসার পথে?"
আরও পড়ুন
সকল ধর্ম সম্প্রদায়ের জন্য সঙ্গত নয় ‘বন্দে মাতরম’, রবীন্দ্রনাথই বলে গিয়েছিলেন সুভাষচন্দ্রকে
সুভাষচন্দ্র খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, "আসল কথা হচ্ছে একটা কিছু পাবার জন্য আগে পাগল হয়ে উঠতে হয়৷ স্বাধীনতার জন্য আমাদেরও সারা দেশটাকে তেমনি পাগল করে তুলতে হবে। তখন হিংসা-অহিংসার প্রশ্ন বড়ো হয়ে উঠবে না।"
বীণা বুঝলেন, সোজা উত্তর এড়িয়ে গেলেন সুভাষবাবু। কিন্তু এও ঠিক, এই প্রশ্নের এর চেয়ে ভালো উত্তর তিনি আর কারোর কাছে পাননি।
তবে, বীণা এবং তাঁর বন্ধুদের ঝোঁকটা ছিল সশস্ত্র বিপ্লবের দিকেই। দেশের কাজ করার সময় প্রায়শই তাঁদের মনে ক্ষোভ হতো, সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র নেই কেন? সকলে মিলে বলাবলি করতেন, "কী ভালোই না হত তা হলে! একবার কল্পনা করো— সুভাষবাবু আমাদের জি.ও.সি. আর আমরা সৈন্যবাহিনীরা চলেছি ইংরেজের সঙ্গে সত্যিকারের লড়াই করতে।"
বীণা আক্ষেপ করেছেন, "পরে নেতাজীর আজাদ-হিন্দ-বাহিনীর মধ্যে আমাদের সেদিনের সেই রোম্যান্টিক স্বপ্ন সফল হয়েছিল, কিন্তু আমরা তো সেদিন কাছে ছিলাম না!"
তবে, বীণা তো থেমে থাকেননি৷ কমলা দাশগুপ্তের কাছ থেকে রিভলভার জোগাড় করে, তিনি তো ভরা সভায় গুলি চালিয়েছিলেন বড়োলাটের দিকে। মা-বাবাকে কাঁদিয়ে কারাগারে গেলেন তরুণী, সেখান থেকে চিঠি লিখলেন...
"পরিপূর্ণ স্বর্গসুখে হানি তীব্র বাজ
অরক্ষিত ক্ষুদ্র নীড়টুকু দোলাইয়া প্রচণ্ড আঘাতে
সারি সর্ব কাজ
হেথা এসে দাঁড়ায়েছি আসি..."
তিনি জানতেন, তিনি সফল হোন বা ব্যর্থ হোন, তাঁর সাধনাই তাঁর পরিচয়৷
জেল খেটে বেরনোর পর আবার নতুন উদ্যোগে কাজে ঝাঁপালেন বীণা। তখন ১৯৪১ সালের জানুয়ারি মাস। সুভাষবাবু অসুস্থ অবস্থায় বাড়িতে রয়েছেন, একদিন হঠাৎ খবর পাঠালেন৷ কারামুক্তির পর একদিনও তাঁর সঙ্গে বীণার দেখা হয়নি। তাই খানিক বিস্মিত হয়েই এলগিন রোডের বসু-ভবনে চললেন বীণা। সোজা দোতলায় উঠে সুভাষবাবুর ঘরে গিয়ে খানিকটা বিষণ্ণ হলেন তিনি। খাটের উপরে শুয়ে আছেন দেশনায়ক, মুখে দাড়িগোঁফের জঙ্গল, বড়ো বেশি রোগা দেখাচ্ছে তাঁকে। তা ছাড়া এতদিন পরে দেখা, এ যেন এক অচেনা মানুষ!
সুভাষবাবু মৃদু হেসে বলে উঠলেন, "বড়ো রোগা দেখছি যেন?"
সেদিন প্রায় একঘণ্টা কথা চলল দুজনার৷ তর্ক হলো অনেক, মীমাংসা হল না।
বীণা উঠে আসার সময় সুভাষচন্দ্র হেসে বললেন, "বড়ো আনন্দ পেলাম, কতদিন পর দেখা!"
বীণা উত্তরে বলে এলেন, "কিন্তু সারাক্ষণ তো ঝগড়াই করে গেলাম আপনার সঙ্গে।"
এর মাত্র চার-পাঁচদিন বাদে কাগজে প্রকাশ পেল নেতাজীর আকস্মিক অন্তর্ধানের খবর৷ বীণা পরে অনেক ভেবেছেন, সেদিন কী মনে করে তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন সুভাষ? তখন তো তাঁর দেশ ছেড়ে চলে যাবার সব আয়োজনই তৈরি। তারই কিছু আভাস দিতে চেয়েছিলেন কি? তাঁর কি ইচ্ছা ছিল, কোনওভাবে দেশসেবার ব্রতে বীণার সাহচর্য?
সারাজীবন ধরে ভেবে গিয়েছেন বীণা। উত্তর মেলেনি।
তথ্যঋণ – শৃঙ্খল ঝঙ্কার – বীণা দাশ
Powered by Froala Editor