১৯৫০ সাল। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় (Sandhya Mukhopadhyay) তখন বাংলার বুকে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন নিজের নাম। একই সঙ্গে চলছে রেকর্ডিং, জলসা আর ‘বাবা’ বড়ে গুলাম আলির কাছে গানের রেওয়াজ। সেই সময়ই মুম্বই থেকে ডাক আসে খোদ শচীন দেববর্মণের। বাংলা ছেড়ে যেতে হবে, কিছুটা ইতস্তত করলেও শেষ পর্যন্ত পৌঁছোলেন মুম্বইয়ে। শুরু হল নতুন যাত্রা। কিন্তু মাত্র দুবছরের মধ্যেই বলিউডের গ্ল্যামার জগতকে পিছনে ফেলে চলে এলেন কলকাতায়। কারণটা কী? নেহাতই বাংলার প্রতি ভালোবাসা, নাকি শিকার হয়েছিলেন কোনো ‘লবি’র?
অথচ ওই দুবছর মুম্বইয়ে অন্তত ১৭টি সিনেমায় গান গেয়েছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। মদনমোহন, মহম্মদ শফিক, পণ্ডিত গোবিন্দ কে নেই সুরকারদের তালিকায়? লতা মঙ্গেশকর, গীতা দত্তের সঙ্গে সমানতালে পাল্লা দিয়ে নিজের গায়কিয়ানার ছাপ রেখেছিলেন সমুদ্রপারের শহরে। তখনও জনপ্রিয় হননি আশা ভোঁসলে। দোভাষী ছবি ‘অঞ্জনগড়’-এর গান শোনার পর শচীন দেববর্মণের স্ত্রী মীরাদেবী ভক্ত হয়ে যান সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের। মীরাদেবীর অনুরোধেই সন্ধ্যাকে মুম্বই নিয়ে যেতে রাজি হন বড়দা রবীন্দ্রনাথ। ‘এভারগ্রিন’ অঞ্চলে থাকার ব্যবস্থাও করে দেন। কিন্তু দিনের পর দিন চলে যায়, শচীন ‘কত্তা’ কোনো গান নিয়ে আসেন না তাঁর কাছে। সম্ভবত যে ছবির জন্য সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে ডেকে এনেছিলেন তিনি, তার সুর তখনও তৈরি হয়নি। শেষে ১৯৫১ সালে অনিল বিশ্বাসের ‘তারানা’ ছবিতে লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে ডুয়েটে প্রথম হিন্দি ছবির গান গাইলেন তিনি। পরে অবশ্য শচীন দেবের সুরে একাধিক হিন্দি গানে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি।
পরের বছর আচমকা কলকাতায় ফিরে আসেন সন্ধ্যা। পরে শুধু রাজ কাপুরের ‘জাগতে রাহো’ সিনেমায় সলিল চৌধুরীর সুরে একটি হিন্দি গান গেয়েছিলেন। নতুবা ১৯৫২-তেই মুম্বইয়ের জগৎ থেকে সরে আসেন তিনি। ১৯৫৪ সালে মুক্তি পেল উত্তম-সুচিত্রা জুটির ‘অগ্নিপরীক্ষা’ সিনেমা। সুচিত্রা সেনের গলায় যেন বসে গেল তাঁর গান। তাঁদের জুটির নেপথ্যে ম্যাটিনি আইডল হয়ে উঠল হেমন্ত-সন্ধ্যার কণ্ঠও। নচিকেতা ঘোষ, রবীন চট্টোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়দের সুরে সিনেমায় ও বেসিক অ্যালবামের গানে বাঙালির ঘরে ঘরে পৌঁছে গেলেন তিনি। কালজয়ী হয়ে রইল প্রতিটি গান।
সেটা তো ঘটত পারত হিন্দি গানের ক্ষেত্রেও। বাংলার মতো সারা ভারত আজ গুণমুগ্ধ ভক্ত হয়ে থাকত তাঁর, যদি না তিনি সেদিন ফিরে আসতেন। একটা স্পষ্ট গুজব ছিল যে, লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতা’-র কারণে মুম্বইয়ে থাকতে পারেননি তিনি, ‘লবি’ করা হয়েছিল তাঁর বিরুদ্ধে। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় নিজে কিন্তু এসব যুক্তি সম্পূর্ণ অস্বীকার করতেন। লতা মঙ্গেশকর কোনোদিন গায়িকা হিসেবে তাঁর সঙ্গে মেশেননি, মিশতেন বন্ধুর মতো, বড়ো বোনের মতো। মুম্বইতে থাকাকালীন দুজনেই একে-অপরের বাড়ি যেতেন। খাবার ভাগ করে খেতেন একসঙ্গে। কলকাতায় এলে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ঢাকুরিয়ার বাড়িতেও যেতেন লতা। দুজনের সম্পর্ক কখনই প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেনি তাঁদের গানের জগতে।
আরও পড়ুন
‘এক বেলার মধ্যেই ফুরিয়েছিল সন্ধ্যাদির অনুষ্ঠানের সমস্ত টিকিট’
১৯৬৬ সালে সুরকার শ্যামল গুপ্তের সঙ্গে বিবাহসূত্রে বাঁধা পড়েন তিনি, প্রায় ১৮ বছর প্রেম চলার পর। মুম্বইতে যাওয়ার বছর দুয়েক আগে থেকেই ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে দুজনের মধ্যে। ফিরে আসার ক্ষেত্রে সেটা একটা বড়ো অনুঘটক তো বটেই, তাছাড়া কলকাতার অনেক সুরকার প্রায়ই চিঠি পাঠাতেন তাঁকে। বিশেষ করে যে সময়টা ওখানে কর্মহীনভাবে বসে থাকতে হয়েছিল, তখন অনেকেই অনুরোধ করতেন ফিরে আসার জন্য।
আরও পড়ুন
অজস্র ‘আধুনিক’ গানের পরও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে নিবেদিতপ্রাণ সন্ধ্যা
কিন্তু আসল কারণটা লুকিয়ে আছে বাংলার প্রতি ভালোবাসায়। মুম্বই তাঁকে দ্রুত খ্যাতি দিলেও, সেখানে ‘মন’ বসেনি কোনোভাবেই। পরে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “আসলে ওই জগতটা অর্থাৎ সেই আবহাওয়ার সঙ্গে নিজেকে ঠিক মেলাতে পারছিলাম না বলেই চলে এসেছি।” একটা পিছুটান, ঘরের জন্য একটা মনকেমন না-গাওয়া গানের মতো গুনগুন করে উঠত ভিতরে। একমাত্র বাংলা ভাষাতেই নিজের মধ্যে গ্রহণ করতে পারেন গানের আত্মাকে। মুম্বইয়ের ব্যস্ত ট্রাফিকে, রঙচঙে রাতের জমকে, মেরিন ড্রাইভের আলোর ঝলকানিতে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছিল সেই উজ্জ্বল একঝাঁক পায়রার দল। বাংলার মাটি, জলহাওয়া ছাড়া তো অপূর্ণ তিনি। তাই ফিরে আসা, ইন্দ্রধনুর সুরে মেলে দেওয়া গানের প্রজাপতি।
কারোর মনে হতেই পারে, হয়তো সবটাই মুখের কথা, সত্যিই কোনো চাপা বেদনা লুকিয়ে আছে গভীরে। জাতীয়স্তরে যে সম্মান তাঁর প্রাপ্য, তা কোনোদিনই পাননি তিনি। ৯২ বছর বয়সে ভারত সরকারের দেওয়া ‘পদ্মশ্রী’ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। সরকারি খেতাব হয়তো তাঁর পালকে নেই, কিন্তু বাঙালির হৃদয়ের সম্রাজ্ঞী তিনি। সাক্ষাৎ ‘গীতশ্রী’। জনতার ভালোবাসায় বাঁচতে পারার চেয়ে বড়ো সম্মান কি আর কিছু আছে পৃথিবীতে?
ঋণস্বীকার :
ওগো মোর গীতিময়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়
আনন্দলোক, ফেব্রুয়ারি ২০২২
Powered by Froala Editor