ভারতের কর্পোরেট-ক্ষেত্রে বাড়ানো উচিৎ সহনশীলতা, কিন্তু কেন?

যখন থেকে ভারত কোভিড-১৯ অতিমারীর কবলে পড়েছে, বদলে গেছে বাজারের ছবিটাই। সমস্ত ব্যবসার দিকে তাকালে বোঝা যাচ্ছে এটা খুবই কঠিন সময়। কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে যে বিশেষ আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছিল, সেটা সুড়ঙ্গ শেষের একটু আলো হয়তো হতে পারে। কিন্তু এই ঝড় থেমে যাবার পরেও, স্থিতাবস্থায় আসার রাস্তাটা যে কতটা মুশকিল এবং সময়সাপেক্ষ— তা বিলক্ষণ জানেন শিল্পপতিরা। আর এই কাজটি হওয়ার জন্য স্রেফ কারিগরি বুদ্ধি ও পড়াশোনা থাকলেই হবে না; আরও বেশি কিছু চাই। হিউম্যান রিসোর্স বা মানবসম্পদের দিক থেকে, এখন সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হল সহনশীলতা তৈরি করা; যাতে কর্মীরা আরও বেশি কাজে উৎসাহী হয়, এবং এমন সংকটের পরিস্থিতির সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারে। 

এই ধরণের প্রোজেক্টের জন্য কাজের পরিবেশে পজিটিভ সাইকোলজিকে আরও বাড়াতে হবে। যদিও এটাও সত্যি যে, সহনশীলতা এক একজন মানুষের ব্যক্তিগত স্বভাবের ওপর নির্ভর করে। আর এটা তো কারিগরি দক্ষতা, কম্পিউটারের প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজের মতো সামনে থেকে দেখাও যায় না। বা আলাদা করে প্রশিক্ষণ দিয়ে, কোর্সের মাধ্যমে সহনশীলতা শেখানোও যায় না। 

দ্বিতীয়ত, শুধুমাত্র সহনশীলতা দিয়েই সবটা হবে না। এই বিষয়টি বোঝানোর জন্য যদি নির্দিষ্ট কিছু প্রোগ্রাম তৈরি করা হয়, তাহলে হয়তো সেটা ভবিষ্যতের জন্য ফলপ্রসু হবে। কিন্তু সমস্যাটা হল, কেবলমাত্র একটি বিষয়ের ওপরই ব্যাপারটি দাঁড়িয়ে থাকবে। যদিও পজিটিভ সাইকোলজিস্ট বারবারা ফ্রেডরিকসনের গবেষণা বলছে, একজন তাঁর কাজের প্রতি যত বেশি উৎসাহ থাকবেন, তাঁর আশা, ভরসা, কৃতজ্ঞতার জায়গাগুলো বজায় থাকবে; ততই সেই মানুষটির সহনশীলতা বাড়বে। তাঁর এই ব্যাপারটা অন্যদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়বে। বারবারা এটাও বলছেন, কাজের জায়গায় যত বেশি পজিটিভ পরিবেশ থাকে, তত স্ট্রেস বা চাপের পরিস্থিতি কমে। সেইসব মুহূর্ত থেকে বেরিয়ে আসার মতো শক্তিও তৈরি হবে মনে। আর এই জিনিসটা হলে আখেরে ওই টিম, এবং ওই সংস্থারই লাভ। প্রাইস ওয়াটারহাউস কুপার্সের গবেষণা এও বলছে, কাজের জায়গায় যদি মানসিকভাবে খুব ভালো থাকা যায়, তাহলে ফলাফলও খুবই ভালো হয়।

আরও একভাবে পজিটিভ পরিবেশ তৈরি করা যায়। কর্মীদের ভেতরের যে যে ভালো গুণগুলো রয়েছে, সেগুলো নিয়ে কথা বলা উচিত। এগুলোকে হাতিয়ার করে কী করে আরও ভালো জায়গায় যাওয়া যায়, সেই কথা বলা উচিত। তাহলে কর্মীর মনোবল বাড়ে, একটা সুস্থ পরিবেশ তৈরি হয়। আইবিএমের পজিটিভ লিডারশিপ প্রোগ্রাম এই বিষয়টা নিয়েই কাজ করছে। একজন কর্মী যখন নিজের আসল শক্তির জায়গায় দাঁড়িয়ে কাজগুলো করে, তখন সেই কাজও তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। নিজের লক্ষ্যে পৌঁছনো তো সহজ হয়ে যায় বটেই; মানসিক চাপের জায়গাটিও অনেকটা কমে। টিমের লিডার এবং ম্যানেজারদের এই ব্যাপারগুলো নিয়েই ভাবতে হবে। ভিআইএ ইন্সটিটিউটের ‘স্ট্রেংথ@ওয়ার্ক সার্ভে’-র মতে, একজন ম্যানেজার যখন তাঁর কর্মীদের ভালো দিকগুলো সম্পর্কে কথা বলেন, তা নিয়ে মতামত দেন; ৭৮% কর্মীই ভেতরে ভেতরে চাঙ্গা হয়ে ওঠেন। এবং ৬৫% কর্মীরা নিজেদের কাজের জায়গায় আরও উন্নতি করেছেন! 

আরও পড়ুন
লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব আর বেসরকারিকরণ; অর্থনীতি কি দিশাহীন হয়ে পড়ছে ক্রমশই?

ঠিক একইভাবে, গ্যালাপ রিসার্চ বলছে, যে কর্মীরা মনে করছেন কাজের জায়গায় তাঁকে ক্রমশ দূরে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, ম্যানেজার তাঁকে উপেক্ষা করছে; তখনই তাঁরা কাজ থেকে নিজেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছেন। দ্য কর্পোরেট লিডারশিপ কাউন্সিল বলছে, ম্যানেজাররা যখন কর্মীদের দুর্বলতার জায়গাগুলো নিয়েই বেশি কথা বলেছেন, তখন সেই কর্মীদের কাজের মান প্রায় ২৭% পর্যন্ত পড়ে গেছে। আবার যখন ম্যানেজাররা ভালো দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করছেন, উৎসাহ দিচ্ছেন; তখন পারফরমেন্সের উন্নতি হয়েছে প্রায় ৩৬% পর্যন্ত। 

আরও পড়ুন
বেহাল অর্থনীতি, ৭৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি ঋণ খেলাপি এসবিআই-তে

সহনশীলতা বা মানসিক দৃঢ়তার সঙ্গে কাজের জায়গার পরিবেশ ও অন্যান্য বিষয়গুলোও জুড়ে আছে। পি.জে.ক্লও এবং তাঁর সহকারীদের গবেষণাও এমনটাই বলছে। কর্মীদের ভেতরের ভালো গুণ, তাঁদের কাজ নিয়ে প্রশংসা করলে তাঁদের মানসিক জোর বাড়ে, এবং এর প্রভাবও দীর্ঘস্থায়ী হয়। আর এর জন্য একটি সংস্থাকে বেশ কিছু জিনিস মাথায় রাখতে হবে, যেমন: 

আরও পড়ুন
তিন বাঙালি অর্থনীতিবিদের নোবেল-প্রাপ্তি, বিশ্বের অর্থনীতিকে আজও দিশা দেখাচ্ছে বাংলা?

মূল্যায়ন এবং বিশ্লেষণ

কর্মীদের প্রত্যেককে একটি সাইকোমেট্রিক টেস্টের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। এই পুরো বিষয়টির ভেতর দিয়েই কর্মীদের মনস্তাত্ত্বিক মূল্যায়ন করা হবে। তাঁর আসল গুণগুলি কী কী, কোন কোন কাজে তিনি ভালো, তাঁর মাইন্ডসেট কীরকম এই ব্যাপারগুলোই সামনে চলে আসবে। এরপর এইসবই বিশ্লেষণ করে একেকটা লক্ষ্য তৈরি করা হবে। তবে পুরোটাই করা হবে ওই মানুষটির ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য, স্বভাব ও গুণের ওপর নির্ভর করে। এতে কাজের জায়গায় বাকিদের সঙ্গে সম্পর্কও ভালো থাকবে, ওই ব্যক্তিরও মানসিক চাপ কম হবে এবং পরিবেশটিও ভালো হবে। 

হস্তক্ষেপ করা এবং প্রশিক্ষণ দেওয়া

একে দুভাবে দেখা যেতে পারে। একেবারে গ্রুপ লেভেলে বেশ কিছু দক্ষ ওয়ার্কশপের আয়োজন করা যেতে পারে। এখানে এমন কিছু বিষয় নিয়ে কাজ করা যেতে পারে যা ব্যবসায়িক দিক থেকে ভালো। সেইসঙ্গে কর্মী নিয়োগ, কেরিয়ারের অগ্রগতি, অফিসের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টকে নতুন করে তৈরি করা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলিকেও মাথায় রেখে ওয়ার্কশপ করা উচিত। এখানে সহনশীলতা তৈরি করার ক্ষেত্রে ‘ফোর-সি’ মডেল প্রয়োগ করা যেতে পারে। এই মডেলটি কী? কন্ট্রোল অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণ, কমিটমেন্ট অর্থাৎ অঙ্গীকার, চ্যালেঞ্জ এবং কনফিডেন্স অর্থাৎ আত্মবিশ্বাস। এই চারটি জিনিসকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এই মডেলে। প্রত্যেকের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আলাপ-আলোচনা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে এই বিষয়গুলি তৈরি করে নেওয়া যায়। 

ফলো-আপ অ্যাসেসমেন্ট

কর্মীরা একটা নির্দিষ্ট সময় মেনে এই সাইকোমেট্রিক অ্যাসেনমেন্টের মধ্যে দিয়ে যাবেন। ট্রেসার মেকানিজমের সাহায্যে এই পুরো কাজটির অগ্রগতি নিয়ে মূল্যায়ন করা হবে; এবং পুরো প্রোগ্রামটি ওই কর্মীর কতটা কাজে দিল, কতটা বাস্তবায়িত হল সেসবও দেখা হবে। 

এই মুহূর্তে ভারতের প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে এই প্রোগ্রাম যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে একজন তাঁর ভেতরের যাবতীয় ভালো দিকগুলিকে যাতে মেলে ধরতে পারে, এবং সেই অনুযায়ী কাজ করতে পারে, সেটাই তো দরকার এখন। এই ইঁদুর দৌড়ের পৃথিবীতে, চাপ-প্রতিদ্বন্দ্বিতা-একটানা কাজের দমবন্ধ পরিবেশের ভেতরেই আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। এই প্রোগ্রামগুলিও একদিন করলেই হবে না; দীর্ঘদিন ধরে চালাতে হবে। তবে করোনা-পরবর্তী সময় দাঁড়িয়ে এই জিনিসগুলোই সবার আগে দরকার। আর সেটাই এখনকার দুর্বল অর্থনৈতিক পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করবে। 

Powered by Froala Editor

Latest News See More