গত বছরের কথা। একটি অপমৃত্যু রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছিল গোটা দেশে। হ্যাঁ, সুশান্ত সিং রাজপুতের কথাই হচ্ছে। আর তারপরেই মিডিয়াকে সরগরম করে তুলেছিল ‘ড্রাগ’। আরও বিশেষভাবে বলতে গেলে গাঁজা (Cannabis) এবং চরস (Hashish)। দীপিকা থেকে শুরু করে করন জোহর— তাবড় বলি-তারকাদের বাড়িতে এনসিবি-এর হানা হয়ে উঠেছিল নিত্যদিনের ঘটনা। সম্প্রতি শাহরুখ-পুত্র আরিয়ানের মাদককাণ্ডে ধরা পড়ার পর যেন ফের ফিরে এসেছে ‘হাই’ টাইম। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল আজ থেকে কয়েক দশক আগে স্বাধীন ভারতে কোনোরকম নিষেধাজ্ঞাই ছিল না গাঁজার ওপরে। প্রকাশ্যে বিক্রি হত এই মাদক। তারপর হঠাৎ কেন নিষেধের কড়াকড়ি জারি করল সরকার?
এই প্রশ্নের পিছনেই লুকিয়ে রয়েছে এক দীর্ঘ গল্প। বিশ্ব-রাজনীতির জটিল সমীকরণও। তবে তার আগে ফিরে দেখতে হবে ইতিহাসকেও। গাঁজা বা ক্যানাবিসের ব্যবহার ভারতে চলে আসছে প্রায় তিন সহস্র বছর ধরে। বেদ-সহ একাধিক পৌরাণিক কাহিনীতেই উল্লেখিত হয়েছে ক্যানাবিসের কথা। আর সেই সূত্রে মহাদেবের প্রসঙ্গ আসতে বাধ্য। তবে শুধু নেশার দ্রব্য হিসাবেই নয়, প্রাচীন ভারতে ক্যানাবিস ব্যবহৃত হত ওষুধ হিসাবেও। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। প্রাচীনকাল থেকেই ক্যানাবিসের নির্যাস থেকে উৎপাদিত হত একাধিক আয়ুর্বেদিক ওষুধ। এমনকি ক্যানাবিসকে ‘আধুনিক আয়ুর্বেদের পেনিসিলিন’ বলা হয়।
আর ঠিক এই ‘গুণ’-এর জন্যই ক্যানাবিস রক্তচক্ষু হয়ে উঠেছিল ব্রিটিশ শাসকদের কাছে। প্রাথমিকভাবে ইংরেজরাই নিষিদ্ধ করে গাঁজা। তবে গঞ্জিকাসেবন তখনও অপরাধ হয়ে ওঠেনি। নিষিদ্ধ করার কারণ ছিল আয়ুর্বেদের প্রচলন কমিয়ে অ্যালোপ্যাথির ব্যবহার বাড়ানো। কেননা সেই ওষুধের বাজারের অধিকাংশটাই নিয়ন্ত্রিত হত ব্রিটিশ শাসকদের মারফত। তবে দোহাই দেওয়া হয়েছিল সামাজিক ভারসাম্য রক্ষার।
পরবর্তীতে ভারতের স্বাধীনতার পরেই সমস্ত রকমের বিধি নিষেধ তুলে নেওয়া হয় ক্যানাবিসের ওপর থেকে। তবে পুনরায় জটিলতা শুরু হয় ১৯৬১ সাল থেকে। ষাটের দশকে আমেরিকার চাপে পড়ে গঞ্জিকাকে বিপজ্জনক মাদকের আওতায় নিয়ে আসে রাষ্ট্রপুঞ্জ। রাখা হয় সিন্থেটিক ড্রাগের ক্যাটাগরিতে। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, গঞ্জিকা কি তবে কোকেন কিংবা অন্যান্য ড্রাগের মতো ল্যাবরেটরিতে তৈরি? সহজ উত্তর, না। ভারত এবং রাষ্ট্রপুঞ্জের মধ্যে টানাটানি শুরু হওয়া সেই থেকেই। প্রাথমিকভাবে গঞ্জিকা নিষিদ্ধ করতে রাজি হয়নি ভারত। কেননা তার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ভারতের আদি ইতিহাস, ধর্মবিশ্বাস এবং ঐতিহ্যও। দীর্ঘ দু’দশক ধরে এই লড়াই চলার পর, বৈদেশিক চাপে শেষ পর্যন্ত ১৯৮৫ সালে জারি করা হয় এনডিপিএস আইন। যে আইনের আওতায় গঞ্জিকা এবং চরসসেবনকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে নথিভুক্ত করা হয়। তবে গাঁজা এবং চরসের মতো ক্যানাবিস গাছ থেকে ভাঙ উৎপন্ন হলেও তা ছাড় পায় আইনের থেকে। মূলত, গাঁজা পাতা এবং বীজকে বাইরে রাখা হয় আইনের। গাঁজা পাতা থেকে উৎপাদিত হয় ভাঙ। নিষিদ্ধ হয় ক্যানাবিসের ফুল এবং তার নির্যাস থেকে প্রাপ্ত রেজিন।
আরও পড়ুন
ভ্যাকসিন নিলেই মিলবে জয়েন্ট! করোনা রুখতে গাঁজাই হাতিয়ার ওয়াশিংটন স্টেটে
কিন্তু আইনের মধ্যেও এমন শ্রেণিবিভাগ কেন? কেনই বা মাদক হওয়া সত্ত্বেও ছাড় পেল ভাঙ? উত্তরটা খুবই সহজ। কারণ, ক্যানাবিসের ফুলই মূলত ব্যবহৃত হয় চিকিৎসার কাজে। আশ্চর্যের বিষয় হল, আমেরিকার চাপেই ভারত থেকে গঞ্জিকা নিষিদ্ধ হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই গঞ্জিকা উৎপাদন এবং ব্যবহারকে আইনি স্বীকৃতি দেয় আমেরিকা। যুক্তরাষ্ট্রের ২৯টি রাজ্যেই বর্তমানে গঞ্জিকার উৎপাদন আইনস্বীকৃত। ক্যানাবিস থেকে সেখানে একাধিক ওষুধ উৎপাদনের শিল্পও চলছে রমরমিয়ে। যন্ত্রণানাশক থেকে শুরু করে ক্যানসার চিকিৎসার ওষুধ— সবই তৈরি হয় মূলত আমেরিকায়। তারপর তার রপ্তানি হয় ভারতে। ওষুধের বাজারে এই একছত্র দখল নেওয়াই ছিল আমেরিকার মূল উদ্দেশ্য। সেই কারণেই ভারত-সহ ক্যানাবিস উৎপাদনকারী অন্যান্য দেশগুলি থেকে গঞ্জিকার ব্যবসা বন্ধ করায় আমেরিকা।
আরও পড়ুন
গাঁজায় বিনিয়োগ ব্যর্থ, আশাহত কানাডার ব্যবসায়ীরা
এখানেই শেষ নয়। এবার আসা যাক গঞ্জিকার ‘মাদক’-দশায়। সেদিক থেকে দেখতে গেলেও, বর্তমানে আমেরিকার ১৩টি প্রদেশে মাদক হিসাবেই ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে গঞ্জিকাকে। সবুজ সংকেত দিয়েছে কানাডাও। অন্যদিকে ভারত এখনও আটকে রয়েছে ১৯৮৫-র আইনে। এই বৈষম্যের মূলেও রয়েছে সেই অর্থনীতিই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি সমীক্ষা দেখলেই বোঝা যাবে বিষয়টি। বছর কয়েক আগেই মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা জানিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১১টি রাজ্যে যেখানে গঞ্জিকাসেবন আইনস্বীকৃত সেখানে উল্লেখযোগ্যভাবেই কমেছে মদ এবং সিগারেটের ব্যবহার। উপরি পাওনা কমেছে অপরাধও। অপরাধের কথা পাশে সরিয়ে রেখে দেখলেই বোঝা যাবে অর্থনৈতিক দিকটা। একপ্রকার গঞ্জিকার বিকল্প হিসাবেই যেন সিগারেট এবং মদকে সাধারণের হাতে তুলে দেওয়াটাই উদ্দেশ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। হিসেবটা সহজ, তাতে সামগ্রী রপ্তানির ক্ষেত্রে বড়ো অঙ্কের আয় ঢুকবে রাজকোষে। অন্যদিকে দেখতে গেলে, ভারতের মতো গঞ্জিকা উৎপাদনকারী তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির অর্থনীতিকে আয়ত্তে রাখা যাবে তাদের ট্যাক্স সংগ্রহের সুযোগ বন্ধ করে দিয়ে।
আরও পড়ুন
গাঁজা টানার ক্ষমতা অনুযায়ী দেওয়া হত নাম, পুরনো কলকাতার গঞ্জিকা সেবনের ইতিহাস এমনই
তবে এত আইনের পরেও গঞ্জিকা উৎপাদনে ভাঁটা পড়েনি ভারতে। বরং বেড়ে চলেছে বেআইনি অপরাধচক্র। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাতে হাত রয়েছে স্থানীয় প্রশাসনেরও। ২০১৬ সালে ফরাসি চলচ্চিত্রনির্মাতা ফ্লোরেন্ট ডুপেন্টই তুলে ধরেন সেই ছবি। ভারতভ্রমণে এসে হিমাচলের ২৪০ হেক্টর গঞ্জিকাখেতের ছবি তুলে ধরেন তাঁর ক্যামেরায়। সেইসময়েই জানা গিয়েছিল শুধু হিমাচলের মালানা অঞ্চল থেকেই উৎপাদিত হয় ১২ হাজার কিলোগ্রাম গঞ্জিকা এবং চরস। অথচ, পুলিশের হাতে ধরা পড়ে তার সিকিভাগ। প্রশ্ন থেকে যায়, প্রশাসনের চোখ এড়িয়েই কি তবে চলছে এত বড়ো ব্যবসা? জানা নেই উত্তর।
অবশ্য আন্তর্জাতিক-মহলে সম্প্রতি গঞ্জিকার হাওয়া উল্টোদিকে। গত বছরই গঞ্জিকাকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়েছিল রাষ্ট্রপুঞ্জ। তাতে ভারতের ভোটও গিয়েছিল নিষেধ তুলে নেওয়ার পক্ষেই। তবে সেই প্রেক্ষিতের দোহাই দিয়ে এখনই আইনকে বুড়ো আঙুল দেখানোটা আদতে অপরাধই। এখন দেখার আদৌ ‘গাঁজা’-খুড়ি গল্প আইনসিদ্ধ হয়ে ওঠে কিনা। ততদিন নয়, মিডিয়ার পাতায় রমরমিয়ে চলুক মাদকচক্রের চোর-পুলিশ খেলা…
Powered by Froala Editor