ফটোগ্রাফির আদি যুগ ও বিশ্বের সবচেয়ে ‘প্রবীণ’ মানুষের ছবি

পুরনো অ্যালবামের একটা আলাদা মাদকতা আছে। ফিকে হতে থাকা হলদে বা সাদা-কালো ছবিতে খুঁজে পাওয়া যায় স্মৃতির গুপ্তধন। ফেলে আসা মুহূর্তদের চিনে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা। থাকে কত বয়স্ক মানুষের ছবি, পরের প্রজন্ম হয়তো ভুলে গেছে তাঁদের। শুধু সেই ছবিটি থেকে যায়, একমাত্র স্মৃতি হিসেবে। ফটোগ্রাফির ইতিহাস ঘাঁটলে মেলে এমনই কিছু ‘প্রবীণ’ মানুষের সন্ধান। যাঁদের ছবি তোলা হয়েছিল ফটোগ্রাফির প্রথম যুগে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে কে সেই ‘প্রবীণ’ ব্যক্তি, যাঁর ছবি প্রথম ধরে রাখা হয়েছিল ফটোফ্রেমে? এ বিষয়ে প্রতিযোগীর সংখ্যাও নেহাত কম নয়। চলুন, খুঁজে দেখা যাক, এরকমই কয়েকজন ব্যক্তি ও তাঁদের ছবির ইতিহাস।

কনরাড হেয়ের (Conrad Heyer) : একটা সময় পর্যন্ত ধরে নেওয়া হত যে, কনরাড হেয়েরই ফটোফ্রেমে থাকা বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন ব্যক্তি। ১৮৫২ সালে তোলা হয় তাঁর প্রথম ফটো। ভদ্রলোকের জীবনকাহিনিও বেশ আকর্ষণীয়। পেশায় ছিলেন কৃষক, পরে যুক্ত হয়ে পড়েন আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে। জন্ম আমেরিকার ম্যাসাচুসেটসের ওয়াল্ডোবোরো গ্রামে। যদিও সংশয় আছে জন্মসালটি নিয়ে। প্রাথমিক অনুমান ছিল, ১৭৪৯ সালের ১০ এপ্রিল তাঁর জন্ম। কিন্তু পরবর্তীতে নথিপত্র ঘেঁটে পাওয়া গেছে ভিন্ন তথ্য। তাঁর পরিবার ম্যাসাচুসেটসে এসে পৌঁছোয় ১৭৫২ সাল নাগাদ। সম্ভবত পরের বছর, অর্থাৎ ১৭৫৩ সালে জন্ম তাঁর। ১৮২০ সালে দাখিল করা অবসরকালীন কাগজপত্রে বয়স লেখা আছে ৬৭। সেটিও মিলে যায় আগের হিসেবের সঙ্গে। ১৮৫৬ সালে মৃত্যু ঘটে তাঁর।

ম্যারি মুনরো স্যান্ডারসন (Mary Munroe Sanderson) : জন্ম ১৭৪৮ সালের ১০ অক্টোবর, আমেরিকার লেক্সিংটনে। স্কটল্যান্ড থেকে আগত অভিবাসীরা এই অঞ্চলেই নিজেদের ঠিকানা খুঁজে নিত। ম্যারির পরিবারও ব্যতিক্রম ছিল না। তাঁর স্বামী স্যামুয়েল স্যান্ডারসন আমেরিকার সেনাবাহিনীতে ছিলেন। একে আইরিশ, তার উপর সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে স্বাধীনতা যুদ্ধে। ফলে ব্রিটিশ সেনাদের অত্যাচারও সহ্য করতে হয়েছে তাঁদের। ১৮৫২ সালে ১০৪ বছর বয়সে মারা যান তিনি। সে বছরই তোলা হয় তাঁর ফটোটি।

আরও পড়ুন
ফটোগ্রাফির আদিযুগ ও বাঙালি মহিলা ফটোগ্রাফারের কাহিনি

আরও পড়ুন
আজও ১৬০ বছরের পুরনো পদ্ধতিতেই ছবি তোলেন এই ফটোগ্রাফার

আন্টি মসের (Aunty Moser) : এক দশক আগে পর্যন্ত এই ভদ্রমহিলার নাম সারা বিশ্বের কাছে ছিল অজ্ঞাত। ২০১৪ সালে একটি নিলামে প্রথম দেখা যায় তাঁর ছবিটি। আন্টি মসেরের জন্ম ১৭৪৯ সালে। আর ছবিটি তোলা হয় ১৮৫২ সালের নভেম্বর মাসে। অর্থাৎ, তাঁর বয়স তখন ১০৩ বছর। 

এজরা গ্রিন (Ezra Green) : হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিকের স্নাতক এজরা গ্রিন পেশায় ছিলেন ডাক্তার। দীর্ঘদিন কাজ করেছেন সেনাবাহিনীতে। স্বাধীন আমেরিকার সংবিধান তৈরির জন্য আয়োজিত সভাসমিতিগুলিতেও যাতায়াত ছিল নিয়মিত। তাঁর জন্ম ১৭৪৬ সালে। তার ১০১ বছর পরে ১৮৪৭ সালে তোলা হয় তাঁর ছবিটি। সে বছরই মারা যান তিনি। 

জন অ্যাডামস (John Adams) : পেশায় ছিলেন জুতোপ্রস্তুতকারক। পরে যোগ দেন সেনাবাহিনীতে। জন অ্যাডামসের জন্ম ১৭৪৪ সালে, ম্যাসাচুসেটসে। তাঁর শততম জন্মবার্ষিকীতে তোলা হয় ছবিটি। অর্থাৎ বাকি প্রতিযোগীদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে প্রবীণ ব্যক্তি। অবশ্য ছবি দেখে বোঝাই যাবে না তাঁর বয়স। শোনা যায়, মৃত্যুর দু’বছর আগে চোখ আর কানে সামান্য সমস্যা ছাড়া দিব্যি ছিলেন তিনি। ১৮৪৯ সালে ১০৪ বছর বয়সে মৃত্যু হয় তাঁর। 

সিজার (Caesar) : না, ইতালির মহান সম্রাট নয়, ইনি আমেরিকার এক কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস। এঁর জন্ম সাল নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা। ১৮৫০ সালে আমেরিকার জনগণনা অনুযায়ী সিজারের বয়স ছিল ১১০ বছর! আবার, ভিন্ন মতে তাঁর জন্ম ১৮৩৭ সালে। নিউ ইয়র্কের বেথলহেম অঞ্চলের রেন্সসিলার নিকোলের বাড়ির ক্রীতদাস ছিলেন তিনি। ৮০ বছর বয়সে ‘অবসর’ নেওয়ার পর বাকি জীবনটা ওই পরিবারের সান্নিধ্যেই কাটান। ১৮৫১ সালে নিকোল পরিবারের সদস্যদের দ্বারা তোলা হয় তাঁর ছবিটি। আফ্রিকান-আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গদের প্রাচীন ফটোগ্রাফগুলির ইতিহাসেরও প্রথম দিকেই রয়েছে তাঁর নাম। পরের বছরই মারা যান তিনি। তখন তাঁর বয়স ছিল প্রায় ১১৫ বছর।

এঁরা ছাড়াও বাল্টুস স্টোন, জন ওয়েন প্রমুখরাও ফটোফ্রেমে ধরে রাখা পৃথিবীর সবচেয়ে প্রবীণ ব্যক্তি হয়ে ওঠার অন্যতম দাবিদার। তবে কে সেই ঐতিহাসিক ব্যক্তি, তা একবাক্যে বলা মুশকিল। এই ছবিগুলির অধিকাংশই ‘ড্যাগুয়েরোটাইপ’ ফটোগ্রাফ। যা উনিশ শতকের তিনের দশক থেকেই জনপ্রিয় হতে শুরু করে। ১৮২৬ সালে ফরাসি আবিষ্কারক জোসেফ নিসেফর নিয়েপ্স ‘লে গ্রাসের জানলা থেকে প্রাকৃতিক দৃশ্য’ নামে বিশ্বের প্রথম ছবিটি তোলেন। ফলে, আরও প্রবীণ মানুষের ছবি যে ভবিষ্যতে আবিষ্কার হবে না, তা কে বলতে পারে? 

Powered by Froala Editor