দৈনিক সংক্রমণ ছুঁয়েছে চার লক্ষের সীমারেখা। বর্তমান বিশ্বের করোনা মানচিত্রে অন্যতম হটস্পট এখন ভারত। তবে শুধুই কি ভারত? এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং লাতিন আমেরিকার দেশগুলিও গণ-সংক্রমণের কেন্দ্র হয়ে উঠছে ক্রমশ। এক বছর পেরিয়ে এসেও মহামারীর এই বাড়বাড়ন্তের সম্পর্কে এবার মুখ খুলল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘হু’। বিশ্বের সমস্ত দেশের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং বৈশ্বিক সমন্বয়ের অভাবের কারণেই ক্রমশ প্রকটতর হচ্ছে সংকট, জানালেন ‘হু’-এর ডিরেক্টর গ্যাব্রিয়াস ট্রেডোস।
২০২০ সালের এপ্রিল মাসের কথা। ঠিক এক বছর আগেই ট্রেডোস জানিয়েছিলেন, জাতীয় স্তরে লকডাউনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ‘লকডাউন’-ও প্রয়োজন মহামারীকে আটকানোর জন্য। এই বৈশ্বিক ‘লকডাউন’-এর অর্থ আন্তর্জাতিক পরিবহন এবং পর্যটনে বিধিনিষেধ আরোপ করা। কঠোর করা স্বাস্থ্যবিধি। বলাই বাহুল্য, মহামারীর শুরুতেই এমন পদক্ষেপ নিয়েছিল একাধিক দেশ। বাতিল করা হয়েছিল আন্তর্জাতিক ফ্লাইট। তবে সংক্রমণ খানিকটা আয়ত্তে আসতেই অর্থনীতির কথা ভেবে তুলে নেওয়া হয়েছিল সেসব বিধিনিষেধ। পরবর্তীতে যা শমন হয়ে দাঁড়ায় পৃথিবীর কাছে।
প্রয়োজনীয় সতর্কতার অভাব ভারত তো বটেই পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালিতে ডেকে আনে দ্বিতীয় তরঙ্গে আঘাত। তবে দ্বিতীয় তরঙ্গের ধাক্কা কেটে যাওয়ার পরেও মুক্তি মিলবে না মহামারী থেকে, এমনটাই ইঙ্গিত দিচ্ছে ‘হু’। তার অন্যতম উদাহরণ ইরান। সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশে হানা দিয়েছে কোভিডের চতুর্থ তরঙ্গ। নতুন করে লকডাউন ঘোষণা করেছেন সে দেশের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি।
গ্যাব্রিয়াস ট্রেডোস জোর দিচ্ছেন ঠিক এই জায়গাটাতেই। ইরান, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা কিংবা ভারতের মতো দেশগুলির কাছে এই সংকটে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে প্রথম বিশ্বের উন্নত দেশগুলিকে। নাহলে মারণ ভাইরাসকে রুখে দেওয়া সম্ভব হবে না তাদেরও। পিছিয়ে পড়া এবং উন্নয়নশীল দেশগুলি থেকেই পুনরায় গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে মহামারী। সেই কারণেই বিগত ৯ সপ্তাহে ইউরোপ, আমেরিকা-সহ প্রথম বিশ্বের এই দেশগুলি মহামারীকে অনেকটা আয়ত্তে আনার পরেও ধরেই গোটে বিশ্বে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে সংক্রমণ।
আরও পড়ুন
করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গে বিপর্যস্ত নেপাল, আত্মসমর্পণ সরকারের
বর্তমানে মহামারীর এই প্রকোপকে আটকানোর একমাত্র পথ হল গণ-টিকাকরণ। তবে টিকা কেনার মতো আর্থিক স্বচ্ছলতা নেই পিছিয়ে পড়া দেশগুলির। তাদের জন্য মাস কয়েক আগেই এক উদ্যোগ নিয়েছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কথা ছিল, ‘কোভ্যাক্স’ প্রকল্পের মাধ্যমে উন্নত দেশগুলি ভ্যাকসিন পৌঁছে দেবে কেনিয়, নাইজেরিয়া, সুদান, বলিভিয়ার মতো ৯২টি দেশে। তবে সংকটকালীন এই সময়ে নিজের স্বার্থের দিকটাতেই জোর দিতে ব্যস্ত উন্নত দেশগুলি। হচ্ছে না ভ্যাকসিনের সমবণ্টন। এই প্রকল্পের চুক্তিতে সাক্ষর করেছিল ভারতও। শুরুতেই পাঠানোর কথা ছিল ২০ কোটি ডোজ। পরে আরও ৯০ কোটি ডোজ পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ভারত। কিন্তু দ্বিতীয় তরঙ্গের ধাক্কায় কার্যত নাজেহাল হয়ে, দেশের নাগরিকদের জন্যই সেই ডোজ বরাদ্দ করেছে নয়া দিল্লি। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া থেকেও ভারতে আমদানি করা হচ্ছে ভ্যাকসিন।
আরও পড়ুন
রেমডিসিভির মানেই করোনা-জয় নয়, জানাচ্ছেন চিকিৎসকরা
তবে ভারতে যখন পৃথিবীর বৃহত্তম ভ্যাকসিনেশন ড্রাইভ শুরু করার পরিকল্পনা হচ্ছে, তখন আফ্রিকার অধিকাংশ দরিদ্র দেশগুলিতে সর্বসাকুল্যে হয়তো ভ্যাকসিন পেয়েছেন হাতে গুনে ৫০০ জন। এই অপ্রতুলতার কারণেই মহামারীকে আটকানো অসম্ভব হচ্ছে না বলে অনুমান ‘হু’-এর। সাধারণ নাগরিকদের জন্য সম্ভব না হলেও, জরুরি ভিত্তিতেই এই দেশগুলির স্বাস্থ্যকর্মী ও চিকিৎসকদের জন্য যাতে ভ্যাকসিন বরাদ্দ করা হয় সেই আবেদনই রাখছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
আরও পড়ুন
করোনার একাধিক স্ট্রেন সক্রিয় ভারতে, হার মানছে অ্যান্টিবডিও
তবে শুধু ভ্যাকসিনের সমবণ্টনই নয়। আরও একটি প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভ্যাকসিন ট্রান্সপোর্টেশন। এই মুহূর্তে প্রচলিত অধিকাংশ ভ্যাকসিনগুলিকেই সংরক্ষণ করতে হয় নিম্ন তাপমাত্রার বিশেষ ফ্রিজারে। ব্যতিক্রম শুধু অ্যাস্ট্রোজেনেকা এবং জনসন অ্যান্ড জনসন। তবে অ্যাস্ট্রোজেনেকার উৎপাদন ভারতকেন্দ্রিক হয়ে পড়ায়, তার রপ্তানি এসে ঠেকেছে একেবারে তলানিতে। এই মুহূর্তে ‘সিনোভ্যাক’ ও ‘সাইনোফার্ম’— চিনের এই দুটি ভ্যাকসিনই কেবলমাত্র হাহাকার ঠেকাতে সক্ষম। কারণ, অ্যাস্ট্রোজেনেকার মতোই এই দুটি ভ্যাকসিন সংরক্ষণ করা সম্ভব সাধারণ রেফ্রিজেটারে। তবে এখনও এই দুটি ভ্যাকসিনের পরীক্ষামূলক প্রয়োগে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। প্রকাশ্যে আনা হয়নি সমস্ত তথ্য। তাই এখনও পর্যন্ত চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়নি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বাজারে এই দুটি ভ্যাকসিন চলে আসার পরই একমাত্র আয়ত্তে আসতে পারে পরিস্থিতি, ধারণা বিশ্লেষকদের।
তবে করোনাভাইরাস মহামারী নতুন করে শিক্ষা দিচ্ছে পৃথিবীকে। কোভিড তো বটেই, সেইসঙ্গে ভবিষ্যতে বৈশ্বিক স্তরে মহামারী নিয়ন্ত্রণের জন্য ভ্যাকসিন বণ্টনের পাশাপাশি জোর দিতে হবে সংশ্লিষ্ট দরিদ্র দেশগুলির পরিকাঠামো উন্নয়নেও। মুষ্ঠিমেয় কিছু দেশের হাতে ভ্যাকসিন উৎপাদনের ক্ষমতা থাকলে, এই পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব নয় কখনোই। কিন্তু সেই পরিকাঠামো উন্নয়নে কবে ব্রতী হবে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি? জানা নেই সেই উত্তর…
Powered by Froala Editor