গল্পটা শুরু হোক একটা ছবি দিয়ে। আফগানিস্তানের ধু ধু পাহাড় আর নীল খোলা আকাশ, যেন ডানা মেলে উড়ে যাওয়ার বার্তা দিয়ে যাচ্ছে। ঠিক তার সামনে সেই নীলের ছোঁয়া পরে দাঁড়িয়ে আছে দুজন মেয়ে। কিন্তু এই নীল মুক্তির নয়। বোরখার আড়ালে খাঁচার পাখির মতো সংস্কারের বাধনে বদ্ধ। ফটোগ্রাফার লিনসে আদ্দারিও এরকমই একটি ছবি দেখতে পেয়েছিলেন, তুলেওছিলেন। কিন্তু এর পরের ঘটনার জন্য তৈরি ছিলেন না একদমই। খেয়াল করে দেখলেন, দুই মহিলার একজন বেশ অসুস্থ। খেয়াল করে দেখলেন, তিনি অন্তঃসত্ত্বা। হাসপাতালে শীঘ্রই নিয়ে যেতে হবে। আফগানিস্তানের ওরকম পাহাড়ি এলাকায় হাসপাতাল তো অনেকটা দূরে! যা করতে হবে খুব তাড়াতাড়ি…
কিন্তু মেয়েটি যেতে চাইছেন না। কেন? জানা গেল, তাঁকে স্বামীর ‘অনুমতি’ নিতে হবে। এবং হাসপাতালে স্বামীর নাম নিয়ে ভর্তি হতে হবে। নিজের নামে ভর্তি হলে বা তাঁর অনুমতি না নিলে তাতে হিতে বিপরীত হবে! হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন লিনসে। শেষমেশ মেয়েটির স্বামী অনুমতি দেন এবং হাসপাতালে নিয়ে যান। মেয়েটি বেঁচে যান এবং সুস্থ সন্তানের জন্ম দেন। কিন্তু সবার কপাল এতটাও ভালো হয় না। এমনই বন্দি জীবন সেখানকার মেয়েদের। প্রবল পুরুষতান্ত্রিক শাসনের বাইরে গিয়ে এক মুহূর্ত চলারও স্বাধীনতা নেই…
আফগানিস্তানে এমনই সব অদ্ভুত নিয়ম আছে। মেয়েরা নিজেদের নামে সেখানে বাঁচতে পারে না। অমুকের মেয়ে, তমুকের স্ত্রী কিংবা তমুকের মা হয়েই জীবন কেটে যায় তাঁর। প্রতিবাদ কি আসে না একেবারে? করতে গেলেই অন্ধকারের ভেতর থেকে দৈত্য গলা টিপে ধরে? এমনকি ডাক্তারের কাছেও নিজের নামটুকু লিখতে পারেন না সেখানকার মেয়েরা? লিখতে গেলেই জোটে অত্যাচার। স্বামী জানতে পারে চলে শারীরিক নির্যাতন। ‘বাইরের মানুষদের’ কাছে শুধু পোশাকেই নয়; সব দিক দিয়েই বোরখা পরে থাকাটাই যেন রীতি হয়ে উঠেছে এশিয়ার এই দেশে। তার ওপর তালিবানি শাসন মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে রেখেছিল।
তবে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ একদিন ঘুরে দাঁড়ায় ঠিকই। এখানেও তাই হল। একটু একটু করে আওয়াজ জমছিল মেয়েদের মধ্যে। ২০১৬-১৭ সালে এসে সেই আওয়াজ বাইরে বেরিয়ে আসে। শুরু হয় ‘হোয়্যার ইজ মাই নেম’ আন্দোলন। মূলত সোশ্যাল মিডিয়াতেই হ্যাশট্যাগ আন্দোলন হিসেবে প্রথমে শুরু হয়েছিল। আস্তে আস্তে রাস্তায় নেমে আসে এটি। ২৮ বছরের এক তরুণী লালেহ ওসমানীর হাত ধরে শুরু হয়েছিল এই আন্দোলন। পরবর্তীতে সাধারণ মানুষ ঠেকে সেলেব্রিটি— সবাই এখানে এসে যুক্ত হন। দাবি একটাই, আফগানিস্তানের মেয়েদের পরিচয় হওয়া উচিত তাঁদের নিজেদের নামেই। নামই হয়ে উঠুক তাঁদের অস্ত্র, নিজের নিজের জায়গা খুঁজে নেওয়ার নৌকা। কারোর ভরসা হয়ে বেঁচে থাকার কোনো মানে হয় না। কারোর স্ত্রী, কারোর মা কিংবা কারোর মেয়ে হয়ে কেন সারাটা জীবন বাঁচবে আফগান মেয়েরা! তাঁদের নিজস্ব পরিচয় নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার তো রয়েছে!
আরও পড়ুন
স্কেটিং-এ খুঁজে পাওয়া স্বাধীনতার মন্ত্র, অস্কারের মঞ্চে স্বীকৃতি আফগান মেয়েদের
আন্দোলন শুরু করার পর স্বাভাবিকভাবেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দিক ঠেকে প্রতিরোধ আসে। ২০০১ সাল থেকে তালিবানি শাসন পিছু হটলেও সেই মনোভাব থেকে যায়। কিন্তু আফগানিস্তানের বহু মেয়েও এই আন্দোলনে সায় দেয়নি। কি দরকার এতদিনের রেওয়াজে আঘাত হানার? যেমন চলছে চলুক! পরিবারের সবাই তো খুশিই আছে। তাঁদেরকে চটিয়ে কী লাভ। একদিকে আফগানিস্তান সংসদে এই পুরো বিষয়টি তুলে ধরছেন মারিয়াম সামা, লালেহ ওসমানী, বাহার সোহাইলি, ফারহাদ দারইয়ারা রাস্তায় নামছেন; কিন্তু বাকি সাধারণ মেয়েরা? প্রথমে মানতে পারছিলেন না। স্কুল কলেজে যাওয়ার অনুমতি পেয়েছিলেন, এটাই তখন অনেক! তাতেই কি শেষ হয়ে যাবে সব? মানুষ কি আর উড়বে না?
আরও পড়ুন
হাসপাতালে যেতে ‘অনুমতি’ চাই স্বামীর, আফগানিস্তানের এক অন্তঃসত্ত্বার গল্প এমনই
আন্দোলন এখনও থেমে যায়নি। পথ এখনও অনেক পেরনো বাকি। একবিংশ শতকের বিজ্ঞান, শিক্ষা, প্রযুক্তির ঢেউ আফগানিস্তানেও প্রবেশ করছে। বদলের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে সবাই। কিন্তু পথ অনেক লম্বা। পদে পদে বিপদ। লালেহ, মারিয়ামরা জানেন এখনও অনেকে এমনও আছেন যারা চোখ মেলে খোলা আকাশ দেখেননি। বোরখার বাইরের সুন্দর পৃথিবীটাকে দেখেননি। প্রকৃত শিক্ষাই একমাত্র এই সব বাধা দূর করতে পারে। ‘হোয়্যার ইজ মাই নেম’ আন্দোলন সেই সবেরই কথা বলে। সেই নীল আকাশ, সোনালি পাহাড়ের ওপর কবে ডানা মেলে উড়বে আফগান মেয়েরা, তারই প্রতীক্ষায় সবাই…
আরও পড়ুন
সাতরঙা কার্পেট নিয়ে, কলকাতায় হাজির আফগানি সমকামী লেখক
Powered by Froala Editor