‘প্লিজ এবার ছেড়ে দিন’, মিস শেফালিকে কাতর কণ্ঠে বললেন উত্তম

“তখন আমার ‘অগ্নীশ্বর’ ছবির শুটিং চলছে। আমার এক সহকারী খুব চিন্তিত মুখে আমায় এসে বলল যে ‘ঢুলুদা দাদার মনে হয় কোনো মানসিক সমস্যা হয়েছে। কাঁচের জানলা দিয়ে দেখলাম মেকআপ রুমের ভেতর একা একা কী সব বলে যাচ্ছেন আর কেমন একটা ছটফট করছে। ঘণ্টা খানেক ধরেই এসব চলছে।’ ছুটে গেলাম। বাইরে থেকে কিছু শোনা যাচ্ছে না। অনেক ভেবে দরজা নক করলাম। ভেতর থেকে দরজা খুলে গেল। জিজ্ঞেস করলাম ‘তুমি ঠিক আছ তো উত্তম? আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট বলল তুমি নাকি কেমন ছটফট করছ। বাড়িতে কোনো সমস্যা টমস্যা হয়েছে নাকি’। বলল ‘আরে না না দাদা। আমি তো রিহার্সাল করছিলাম। যা কঠিন সিন লিখেছেন। সঠিক ইমোশন আনাটা খুবই চাপের হয়ে যাচ্ছে।’”

সেদিন সাক্ষাৎকার দিতে-দিতে বলছিলেন বর্ষীয়ান পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়। যাঁকে সিনেজগত ‘ঢুলুদা’ নামেই চেনে। কিন্তু ঠিক কোন সিনের কথা বলছেন তিনি?

সিনটা ছিল যেখানে বুড়ো স্টোর বাবুর(হরিধন মুখোপাধ্যায়) দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী (কাজল গুপ্ত) সুস্থ হয়ে হসপিটাল থেকে ছাড়া পাচ্ছেন। বাড়ি যাওয়ার আগে তিনি ডাক্তার অগ্নীশ্বর অর্থাৎ উত্তম কুমারকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে যান। তখন উত্তম কুমার ছিটকে পেছনে সরে গিয়ে বলবেন ‘আহাহাহা আমাকে প্রণাম করবেন না’। কাজল গুপ্ত জিজ্ঞেস করেন ‘কেন?’ তখন ক্লোজ আপে উত্তম কুমারের সংলাপ ‘না। আমার মায়ের চেহারাটা ঠিক মনে নেই। তুমি যদি আমার চেয়ে বয়েসে ছোটো না হতে তাহলে আমিই তোমাকে একটা প্রণাম করতাম।’ এই বলে উত্তম কুমার চলে যান। এই ছোট্ট ১৫-২০ সেকেন্ডের সিনটা করার জন্য উনি ঘণ্টা খানেক ধরে রিহার্সাল দিয়ে যাচ্ছিলেন, লড়ে যাচ্ছিলেন। আসলে সৎ মা হয়েও ছেলে-মেয়েদের প্রতি এই মহিলার যে ভালবাসা আর স্নেহের প্রকাশ অগ্নীশ্বর-এর আগের দৃশ্যগুলিতে দেখেছিলেন সেই স্নেহই আপাত রাশভারী ও কঠিন হৃদয়ের এই মানুষটাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। মুখ দিয়ে এই সংলাপগুলি বলিয়ে নিয়েছিল। ছবিতে এই প্রথমবার দর্শক অগ্নীশ্বরের ভেতরে লুকিয়ে থাকা কোমল হৃদয়ের প্রকাশ দেখল। আর তার জন্যই ছোটো হলেও দৃশ্যটা উত্তমের কাছে এতটা কঠিন ছিল। 

এর বেশি বলার এখানে অবকাশ নেই। ছবি দেখে অনুভব করতে হবে। অরবিন্দবাবু আরও বলেছিলেন – “ইন্ডাস্ট্রিতে তখন ওঁর ২৬-২৭ বছর কাজ করা হয়ে গেছে। এক কথায় উনিই ইন্ডাস্ট্রি। কিন্তু সেই বয়েসে আর সেই অনুকূল পরিস্থিতিতেও প্রতিটা দৃশ্যকে সর্বোচ্চ উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য ওঁর যে ডেডিকেশন সেদিন আমি দেখেছিলাম সেটা শুধু অভূতপূর্বই নয়, সেটা বিরল। এজন্যই ও গ্রেটেস্ট।” 

আরও পড়ুন
প্রস্তাব ফেরালেন উত্তমকুমার, সেই চরিত্র লুফে নিয়েই বাজিমাত সৌমিত্রের

 

আরও পড়ুন
স্কুলের যাত্রাভিনয়ে প্রথম পুরস্কার প্রাপ্তি; মঞ্চই তৈরি করেছিল ‘অভিনেতা’ উত্তমকে

এখানেই বারবার জিতে যান উত্তমকুমার। এখানেই উনি প্রতিবার আমাদের নতুন করে উদ্বুদ্ধ করেন আর এভাবেই উনি আমাদের মধ্যে বেঁচে আছেন। অবশ্য উত্তম কুমারের এই ধরনের গল্পগুলি আমরা সকলেই কম-বেশি জানি। আজকে অন্যরকম কিছু গল্প বলা যাক।

বছরকয়েক আগের কথা। সাক্ষাৎকার নিচ্ছি মিস শেফালির। উত্তমকুমার সম্পর্কে শ্রদ্ধা দেখেছিলাম তাঁর চোখেও। ঠিক কী বলেছিলেন তিনি? তাঁর বয়ানেই রইল—

“বুড়োদা অর্থাৎ তরুণ কুমার আমাকে বোন বলতেন। খুবই স্নেহ করতেন। তুই বলে ডাকতেন। আমি ওঁকে ভাইফোঁটা দিতাম। কিন্তু উত্তমদা আমাকে প্রথমদিকে কখনোই তুই বলতেন না। আমাকে বোন হিসেবে কিছুতেই মেনে নিতে পারতেন না। মিস শেফালির নজরেই দেখতেন। ততদিনে উত্তম কুমারের সঙ্গে কয়েকটা ছবিতে অভিনয়ও করে ফেলেছি। কিন্তু কাজের বাইরে কথাবার্তা কিছু হয়নি। আমিও বিশেষ পাত্তা দিতাম না। তুমি উত্তম কুমার হলে আমিও মিস শেফালি। আমিও ওয়ার্ল্ড ফেমাস। এইরকম ছিল আমার অ্যাটিচুড। উনি আমাকে দেখতেন কিন্তু কিছু বলতেন না। তবে পরবর্তীকালে উত্তমদার সঙ্গে আমার একটা সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। 

“বেণুদি অর্থাৎ সুপ্রিয়া দেবীর সাথেও খুবই হৃদ্যতা ছিল। শেখর চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ‘সাহেব বিবি গোলাম’ নাটকে আমি বেণুদির সঙ্গে অভিনয় করেছি। আমার চরিত্র ছিল বাইজি চুনিদাসীর। বেণুদি ছিলেন নায়িকা। তারপর আমি দাদার বাড়িতে যেতাম আড্ডা মারতে। দাদাও আমার সার্কাস এভিনিউয়ের বাড়িতে অনেকবার এসেছেন। দোলের সময়ও এসেছেন। শেষবার যখন এসেছিলেন তখন আমার কাছে একটা টি সেট চেয়েছিলেন। আসলে আমার একটা টি সেট ছিল যাতে আমার নাম লেখা ছিল। বাংলায় এবং ইংরাজিতে। উত্তমদা দেখে বলল ‘আমার ধুতিতে নাম লেখা থাকে আর তোর কাপে নাম লেখা।’ আমি বললাম তোমার কি এরকম কাপ লাগবে? ‘লাগবে মানে। অবশ্যই লাগবে।’ ওঁর জন্য একটা সেট বানিয়ে দিয়ে এসেছিলাম। ওটাই শেষ দেখা। 

“উত্তমদা একবার আমাদের এই নাটকটা দেখতে এসেছিলেন। এটা আমার সঙ্গে ওঁর দ্বিতীয় আলাপ। প্রথম আলাপ হয়েছিল গ্র্যান্ডে। উনি যেদিন এসেছিলেন সেদিন আমার হাওয়াইন ডান্সের পারফর্মেন্স ছিল। এই নাচের নিয়ম হল আমার হাতে একটা মালা থাকবে। সেই মালাটা আমি যার গলায় পরিয়ে দেব তাকেও আমার সঙ্গে নাচতে হবে। সেদিন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আমার কাছে রিকোয়েস্ট এসেছিল যে উত্তম কুমার আসছেন, আমি যেন মালাটা ওঁকে পরাই। সঙ্গে বেণুদিও ছিলেন। তো আমি মালাটাতে প্রচুর পারফিউম মাখিয়ে নিয়েছিলাম। নর্মালি এত মাখাই না। তারপর মালা পরিয়ে দাদাকে প্রচুর নাচিয়েছিলাম। কোমরের হাড়গোড় ভেঙে যাওয়ার যোগাড় হয়েছিল। একটা সময় পর দাদা আমায় ফিসফিস করে বললেন ‘এই নাচ কি শেষ হবে না?’ আমিও কানে কানে বললাম যখন আমার ইচ্ছে হবে তখন শেষ হবে। বললেন ‘প্লিজ এবার থামান।’ আমি বললাম এখনই হাঁপিয়ে গেলেন। আমি তো হাঁপাইনি। আমি তো আরও ডান্স করাব। বললেন ‘না না প্লিজ এবার ছেড়ে দিন। খুব খারাপ অবস্থা।’ তারপর আমি ছেড়ে দিলাম। উত্তমদা তারপর বললেন ‘আমাদের টেবিলে আসবেন তো?’ আমি বললাম বসের পার্মিশন নিতে হবে। যদিও আমার পার্মিশন নিতে হত না। বললেন ‘নানা প্লিজ আসুন।’ গেছিলাম। ওরকম ভাবে তাকিয়ে বললে কি আর না গিয়ে থাকা যায়। 

“যেটা বলছিলাম আগে। দাদা আমাদের ‘সাহেব বিবি গোলাম’ নাটকটা দেখতে এসেছেন। নাটক শেষে গ্রিনরুমে এসে বসেছেন। দিদিও পাশে বসে। সবাই ওঁকে ঘিরে আছে। জিজ্ঞেস করছে, তাদের পার্ট ওঁর কেমন লেগেছে। আমিও গেলাম। আমি একটা নীল ম্যাক্সি পরেছিলাম আর চুলটা স্টাইল করে বেঁধেছিলাম। দাদা আমায় দেখে বললেন, ‘হ্যাঁ, ছোটোবাবু কেন যাবে না চুনিদাসীর কাছে! চুনিদাসী যদি দেখতে এত সুন্দর হয় আর এত সুন্দর নাচে তাহলে ছোটোবাবু তো সেখানেই পড়ে থাকবে। আমি হলে তো আমিও সবসময় পড়ে থাকতাম।’ আর ঘরের সব লোক হোহো করে হেসে উঠল। আর আমি দিদির দিকে তাকিয়ে দেখলাম যে দিদির মুখটা একেবারে ছোট্ট হয়ে গেল। তারপর যখন দাদা চলে গেছে, দিদি আমাকে ডেকে বলল ‘এই শোন। তুই না এতো সাজিস না রে। একটু কম করে সাজবি’। আমি বললাম, আশ্চর্য তো! চুনিদাসী তো সাজবেই। নইলে ছোটোবাবু আসবে কেন। ঘরের বৌকে ছেড়ে যে চুনিদাসীর কাছে আসবে সে তো দেখতে সুন্দর বলেই আসবে। আর মনে মনে বলছি, এরপর আরও বেশি করে সাজব।”

এরপর কী হয়েছিল, আমরা তা জানি না। ওঁদের মধ্যে প্রেম হয়েছিল কিনা তাও আমরা জানি না। হলেও সেটা আশ্চর্যের বা অস্বাভাবিক কিছু না। শোনা যায় বহু নায়িকার সঙ্গেই নাকি উত্তম কুমারের এরকম প্রেম হয়েছিল। কিন্তু উনি প্রেমেও ছিলেন আবার কর্মযোগীও ছিলেন। প্রেমিকস্বত্তা আর শিল্পীস্বত্তা সমান্তরালভাবে চলত। আর সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ, কোনো নায়িকাই ওঁকে নিয়ে বিরূপ ধারণা পোষণ করেন না। তা সেই প্রেম পূর্ণতা পাক আর না পাক। এজন্যই উনি সর্বোত্তম।  

(সূত্র - লেখকের নেওয়া অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় ও মিস শেফালির সাক্ষাৎকার)

Powered by Froala Editor