মেক্সিকোতে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্র-হানা, তাও আবার ‘ভুলবশত’!

সত্তরের দশকের শুরুর দিক সেটা। মার্কিন-সোভিয়েতের ঠান্ডাযুদ্ধ তখন মধ্যগগনে। এরই মধ্যে ঘটে গিয়েছিল আরও এক আশ্চর্য ঘটনা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক আঘাত হানতে সক্ষম আন্তঃমহাদেশীয় অর্থাৎ ইন্টার-কন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইল আছড়ে পড়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেশী দেশ তথা ‘মিত্র-মুলুক’ মেক্সিকোয়। এই আশ্চর্য ঘটনা সে-সময় সাড়া ফেলে দিয়েছিল গোটা বিশ্বজুড়ে। তবে কী আন্তর্জাতিক ক্ষমতার সমীকরণ হঠাৎ করে বদলাতে শুরু হয়েছে আবার? 

না, বিষয়টা তেমনটা নয়। ‘ভুল’ করেই এই ক্ষেপণাস্ত্র (Missile) আঘাত হেনেছিল মেক্সিকোয় (Mexico)। শুরু থেকেই বলা যাক বিষয়টা। ১৯৬২ সালে আমেরিকাকে জব্দ করতে কিউবায় পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। অন্যদিকে সোভিয়েতকে চাপে রাখতে তুরস্কে পারমাণবিক হাতিয়ার মোয়াতেন করে যুক্তরাষ্ট্রও। তবে সোভিয়েত আক্রমণের জন্যও সম্পূর্ণভাবে মধ্যপ্রাচ্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে চায়নি যুক্তরাষ্ট্র। তাই ষাটের দশকেই বিশেষ ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, যা আমেরিকা থেকে উড়ান দিয়ে সহজেই পৌঁছে যেতে পারে এশিয়াতেও। 

আশ্চর্য এই ক্ষেপণাস্ত্রকে আজ গোটা পৃথিবী চেনে ‘ইন্টারকন্টিনেন্টাল মিসাইল’ (Intercontinental Ballistic Missile) নামে। তবে একদিনে তৈরি হয়নি এই মিসাইল। ১৯৫৫ সালে প্রথম এই ধরনের মিসাইল তৈরির প্রকল্প নেয় যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৫৯ সালে প্রকাশ্যে আসে প্রথম আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক মিসাইল ‘অ্যাটলাস আইসিবিএম’। অবশ্য এই মিসাইলের ভারবহন ক্ষমতা এবং পরিসীমা— দুই-ই ছিল সীমিত। সেই ঘাটতি পূরণ করতেই ১৯৬২ সালে কিউবা সংকটের পর শুরু হয় ব্যালিস্টিক মিসাইল ‘অ্যাথিনা’ (Athena) প্রকল্প।

মার্কিন সংস্থা লকহিড মার্টিনের নির্মিত ৫০ ফুট দীর্ঘ এবং ১৬ হাজার পাউন্ডের এই মিসাইল বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ঘাতক ক্ষেপণাস্ত্রগুলির মধ্যে অন্যতম। ১৯৬৪ সালেই নির্মাণকার্য শেষ হয়েছিল ‘অ্যাথিনা’-র। অবশ্য তারপর প্রায় দেড় দশকেরও বেশি সময় চলেছে এই ঘাতক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষানিরীক্ষা। আর এই পরীক্ষার সময়ই দুর্ঘটনাবশত মেক্সিকোতে আঘাত হেনেছিল পারমাণবিক অস্ত্র পরিবহনে সক্ষম মার্কিন মিসাইল ‘অ্যাথিনা’। 

সেটা ১৯৭০ সালের ১১ জুলাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউটা প্রদেশের গ্রিন রিভার সেনাকেন্দ্রে মোতায়েন করা হয়েছিল ‘অ্যাথিনা-১২২’-কে। হ্যাঁ, ঘাতক এই ক্ষেপণাস্ত্রের ১২২তম পরীক্ষণ ছিল এটি। লক্ষ্য ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকো প্রদেশের হোয়াইট স্যান্ডস মিসাইল রেঞ্জে আঘাত হানা। প্রত্যাশিতভাবেই উড়ান নিয়েছিল এই ব্যালিস্টিক মিসাইল। পূর্ব-নির্ধারিত পথেই এই মিসাইল অতিক্রম করে শুরুর প্রায় ২০০ মাইল রাস্তা। তারপরই দুর্ঘটনার শিকার হয় অ্যাথিনা। দিক পরিবর্তনের সময় বিস্ফোরণের ফলে মিসাইলের পিছনের অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় মিসাইলের ট্রান্সমিটার সিস্টেম। অর্থাৎ, সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এই ঘাতক ক্ষেপণাস্ত্র। এমনকি সেটি কোথায় আঘাত হানতে চলেছে, তা জানারও কোনো উপায় ছিল না মার্কিন সেনানীদের কাছে। 

যে-সময় এই দুর্ঘটনা ঘটে, তখন অ্যাথিনার গতিবেগ প্রতিসেকেন্ডে ৪.২৫ মাইল। কর্মরত গবেষকরা বুঝতে পেরেছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সীমা ছাড়িয়ে এই মিসাইল পৌঁছে যাবে মেক্সিকোতে। তার চেয়েও বড়ো কথা হল, পরীক্ষামূলকভাবে এই মিসাইলের মধ্যে রাখা ছিল তেজস্ক্রিয় মৌল। অবশ্য হিরোশিমা-নাগাসাকির মতো ইউরেনিয়াম বা প্লুটোনিয়াম নয়, পরীক্ষার জন্য তুলনামূলকভাবে কম তেজস্ক্রিয় ‘কোবাল্ট-৫৭’ আইসোটোপ ব্যবহার করেছিলেন মার্কিন বিজ্ঞানীরা। 

আগাম বিপর্যয়ের আশঙ্কা টের পেয়েই দ্রুত টেলিমেট্রি সংকেত পাঠানো হয় তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের কাছে। মেক্সিকো প্রশাসনের কাছে এই বার্তা পাঠান স্বয়ং তিনিই। তবে মজার বিষয় হল, এহেন ঘাতক ক্ষেপণাস্ত্র যে মেক্সিকোতে আঘাত হেনেছে, সে-ব্যাপারে বিন্দুমাত্রও জানত না মেক্সিকো সরকার। তার একটি কারণ, সৌভাগ্যবশত ক্ষেপণাস্ত্রটি আছড়ে পড়েছিল সে-দেশের দুরঙ্গো প্রদেশের মাপিমি মরুভূমিতে। যার ৪০০ মাইলের মধ্যে জনবসতি নেই কোনো। 

অবশ্য এই তথ্য সামনে এসেছিল ‘অ্যাথিনা’-দুর্ঘটনার প্রায় এক মাস পরে। সন্ধান করেছিলেন খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনারাই। তবে কোনো প্রাণহানি না ঘটলেও, সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল তেজস্ক্রিয়তা। মার্কিন রিপোর্ট অনুযায়ী, সেই পারমাণবিক বর্জ্য অপসারণের জন্য খনন করতে হত কয়েকশো টন বালি। শুনশান মরুভূমিতে কার্যত যা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রথমত, এই প্রকল্পের জন্যও প্রয়োজন ছিল অন্ততপক্ষে ৪৫০ মাইল রাস্তা নির্মাণ। ফলে গোটা বিষয়টি ছিল যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ। দ্বিতীয়ত, তা যথেষ্ট ব্যয়বহুলও বটে। ফলে শেষ অবধি বর্জ্য পরিষ্কার প্রকল্প থেকে পিছিয়ে আসে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাশালী শক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তোলেনি মাক্সিকোও। কেবলমাত্র নিষিদ্ধ এলাকা হিসাবে ঘোষণা করা হয় অঞ্চলটিকে। যা আজও স্বল্পমাত্রায় তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ছড়িয়ে চলেছে মাপিমি মরুভূমিতে…

Powered by Froala Editor