চলতি বিশ্বকাপের ফেভারিট তাঁরা। প্রথম ম্যাচেই ইরানের বিরুদ্ধে ৬-২ গোলের বড়ো জয় দিয়েই শুরু করেছিল টুর্নামেন্ট-অভিযান। তবে গতকাল হঠাৎ-ই যেন নিভে গেল সেই আগুন। মার্কিন খেলোয়াড়দের সামনে থিতিয়ে পড়ল তিন-সিংহের গর্জন!
হ্যাঁ, ইংল্যান্ডের কথা হচ্ছে। বিশ্বকাপ (World Cup) মানেই অঘটনের ঘনঘটা। এবারেও তার অন্যথা হয়নি কাতারে। সৌদি আরবের আর্জেন্টিনা-জয় কিংবা জাপানের জার্মান-বধ— একের পর এক অঘটন ঘটে চলেছে শুরু থেকেই। এবার সেই তালিকাকে আরও দীর্ঘ করল যুক্তরাষ্ট্র (USA)। গতকাল ০-০ ব্যবধানে রুখে দিল বিশ্বকাপ-ফেভারিট ইংল্যান্ডকে। তবে এই প্রথম নয়, নজরকাড়া দল নিয়েও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বকাপের ময়দানে কখনও হারাতে পারেনি ইংল্যান্ড।
এই গল্পের শুরু ১৯৫০ সালে। ব্রাজিল বিশ্বকাপ। সে এক ঐতিহাসিক বিশ্বকাপই বটে। ১৯৩৮ সালের পর দু’বছর টানা বন্ধ ছিল বিশ্বকাপ। অর্থাৎ, টানা ১২ বছর পর বিশ্বকাপ আয়োজিত হয়েছিল লাতিন আমেরিকার দেশটিতে। সেবারের টুর্নামেন্ট ফেভারিট ব্রাজিল হলেও, যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল ইংল্যান্ডের দল। দুর্ভাগ্যবশত দুই দলকেই শিকার হতে হয়েছিল অঘটনের। ব্রাজিলের মারাকানা ট্র্যাজেডির কথা তো সকলেরই জানা। তবে দ্বিতীয় অঘটনটির কথা চাপা পড়ে গেছে ইতিহাসের পাতায়। আর তা হবে নাই বা কেন? সেদিন এই ম্যাচ কভার করতে হাজির ছিল না কোনো আন্তর্জাতিক এমনকি স্থানীয় সংবাদমাধ্যমও। কেবলমাত্র একজন মার্কিন সাংবাদিকই নিজ-উদ্যোগে হাজির হয়েছিলেন বেলো হরিজন্তে স্টেডিয়ামে।
আসলে সেই বিশ্বকাপে সবচেয়ে দুর্বল দল ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বকাপের আগের সাতটি ম্যাচে পরাজয় তো বটেই, সবমিলিয়ে ৪৫টি গোল হজম করতে হয়েছিল তাদের। তার কারণও আছে যথেষ্ট। মার্কিন শিবিরের একজন ফুটবলারও ছিলেন না পেশাদার খেলোয়াড়। অর্থাৎ, ফুটবল খেলার সঙ্গে যুক্ত থাকলেও, তাঁদের মূল পেশা ফুটবল না। কেউ ছিলেন সমাধিক্ষেত্রের নিতান্ত নিরাপত্তাকর্মী, কেউ কয়লা খনির শ্রমিক, কেউ আবার পোস্টম্যান।
এই ভাঙা দল নিয়ে মাঠে নামার খেসারতও দিয়ে হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রকে। প্রথম ম্যাচেই স্পেনের বিরুদ্ধে ৩-১ গোলে পরাজিত হয় যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিতীয় ম্যাচ পড়েছিল তারকামণ্ডিত ইংল্যান্ডের সঙ্গে। ফলে সকলেই অনুমান করেছিলেন, ইংল্যান্ড অক্লেশে জয় ছিনিয়ে নেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থেকে। শেষ পর্যন্ত অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায় সেটাই। বরং, ১-০ গোলে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে অলৌকিক ইতিহাস রচনা করে অপেশাদার দলটিই! স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল মাঠে উপস্থিত ১০ হাজার ব্রিটিশ সমর্থক।
কিন্তু এত কিছুর পরেও যে প্রশ্নটা থেকে যায়, তা হল অপেশাদার ফুটবলারদের নিয়ে কেন এমন দল তৈরি করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র? ১৯৩০ সালের আয়োজিত প্রথম বিশ্বকাপে যে দেশ তৃতীয় স্থান অধিকার করেছিল, তার থেকে কি এমনটা আদৌ কাম্য?
আসলে এর পিছনে লুকিয়ে রয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস। ১৯২০ সালের আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রীতিমতো জনপ্রিয় ছিল ফুটবল থুড়ি সকার! হ্যাঁ, এই নামেই ফুটবল প্রচলিত যুক্তরাষ্ট্রে। বরং, রাগবিকেই ‘ফুটবল’ বলে অভিহিত করেন মার্কিনিরা। সে যাই হোক না কেন, বিশ শতকের শুরুতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে গজিয়ে উঠেছিল একাধিক সকার-ক্লাব। আয়োজিত হত নানান প্রাদেশিক টুর্নামেন্টও। কর্পোরেট স্পনসরশিপও মিলত যথেষ্ট। তবে ২০-এর দশকের ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দাই সম্পূর্ণভাবে ‘নিশ্চিহ্ন’ করে দেয় ‘আমেরিকান সকার লিগ’-কে।
সে-সময় যাঁরা বিভিন্ন ক্লাবে ফুটবল খেলতেন ১৯৩০ কিংবা ৩৪-এর বিশ্বকাপে মাঠে নামেন তাঁরাই। তবে জনপ্রিয় ফুটবল ক্লাবগুলির আকস্মিক ‘মৃত্যু’-তে আর তৈরি হয়নি পরবর্তী প্রজন্মের কোনো ফুটবল তারকা। ১৯৩৩ সালে যখন দ্বিতীয়বার আমেরিকান সকার লিগ চালু হয়, তখন হাতে গোনা তিন-চারটে দল অংশ নিত এই প্রতিযোগিতায়। যার মধ্যে অধিকাংশ দলেই খেলতেন অভিবাসী জার্মানরা। এমনকি ‘ফিলাডেলফিয় জার্মান’ নামে একটি স্বতন্ত্র দলও উপস্থিত ছিল যুক্তরাষ্ট্রে।
ফুটবল তথা ‘সকার’-কে বাঁচানোর এই প্রচেষ্টা দ্বিতীয়বারের জন্য মাঠে মারা যায় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরেই। ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় প্রতিটি ক্লাবই। এমনকি জার্মানদের সে-সময় খাতায়-কলমে বয়কট করেছিল আমেরিকানরা। বয়কট নয়, বরং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই তাঁদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল দল থেকে।
বিশ্বযুদ্ধের পর যখন ১৯৫০-এর বিশ্বকাপের প্রস্তুতি শুরু হয় তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিবিরে ছিলেন কেবলমাত্র একজন স্থায়ী স্টাফ এবং একজন পেশাদার ফুটবলার। ডগলাস-খ্যাত সেই ফুটবলার কয়েক বছর খেলেছিলেন সেন্ট লুইস নামের এক স্থানীয় সকার দলের হয়ে। তাঁর ওপরই ভার পরে বিশ্বকাপের দল তৈরি করার। ততদিনে সোভিয়েতের সঙ্গে শুরু হয়ে গেছে কূটনৈতিক যুদ্ধ— ঠান্ডা লড়াই। তবে সোভিয়েত সক্রিয়ভাবে ফুটবল বিশ্বকাপে অংশ না নেওয়ায় সেভাবে এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি মার্কিন প্রশাসন। অন্যদিকে ডগলাস দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে একত্রিত করেন কিছু সকার-প্রেমীদের। যাঁরা ফাইভ কিংবা সেভেন সাইট মাঠে ছোটো গোলে খেলেই অভ্যস্ত। দিনের শেষে ‘সকার’ বল পেটানো তাঁদের কাছে বিনোদন মাত্র। তাঁদের নিয়েই তৈরি হয় নড়বড়ে একটি দল। ৭ ম্যাচে ৪৫ গোল খাওয়ার কথা তো বলা হয়েছে আগেই। তবে অনভিজ্ঞ দল কিউবার বিরুদ্ধে ৫-২ গোলে জয় ছিনিয়ে এনে বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন করেন মার্কিনিরা।
অবশ্য এই দলই যে টুর্নামেন্ট-ফেভারিট ইংল্যান্ডকে রুখে দেবে তা ভাবতে পারেননি কেউই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই আশ্চর্য কৃতিত্বে চমকে গিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নও। উল্লেখ্য, এই বিশ্বকাপের পরই ধীরে ধীরে ‘সকার’-এ বিনিয়োগ শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। এর ঠিক ৬০ বছর পর ২০১০-এর বিশ্বকাপে দ্বিতীয়বারের জন্য ইংল্যান্ডের মুখোমুখি হয় আমেরিকা। সেভাবেও ১-১ গোলে অমীমাংসিত থেকে যায় ম্যাচ। এবার চলতি বিশ্বকাপেও বজায় থাকল সেই ট্রেন্ড। সকার বনাম ফুটবলের এই নাছোড় লড়াই রীতিমতো অবাক করার মতোই…
Powered by Froala Editor