বাড়ি থেকে বেরনোর সময় প্রতিদিনই হোঁচট খেতে হত একটি পাথরে। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েই সেই পাথরকে উপড়ে ফেলতে হয়েছিল। তার ঠাঁই হয় রাস্তার ধারে। অশ্বত্থ গাছের গোড়ায়। তবে আশ্চর্যের বিষয়, দিন কয়েকের মধ্যেই তার গায়ে চাপে সিঁদুর-হলুদ। সামান্য পাথরটিই হয়ে ওঠে আরাধ্য দেবতা।
চেনা লাগছে খুব এই গল্প? হ্যাঁ, শিবরাম চক্রবর্তীর লেখা ‘দেবতার জন্ম’-এর কথাই হচ্ছে। কিন্তু এই গল্পের প্রেক্ষাপট যদি কলকাতা কিংবা বাংলা না হয়ে আমেরিকা হয়? অবাক লাগলেও সত্যি। আজ থেকে তিন দশক আগে এমনটাই হয়েছিল খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে (USA)। রাতারাতি ‘দেবতা’-র তকমা পেয়েছিল অতি সাধারণ একটি প্রস্তরখণ্ড। খুলেই বলা যাক সেই গল্প।
১৯৯৩ সাল। নতুন করে সেজে উঠছে সান ফ্রান্সিসকোর রাস্তাঘাট। রাস্তার দু’ধারে বসছে নতুন রেলিং, সুন্দর ল্যাম্পপোস্ট। সেইসঙ্গে শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য পাথর কিংবা কংক্রিট নির্মিত শহরের প্রাচীন ট্রাফিক ব্যারিয়ারগুলি উপড়ে ফেলে বসানো হচ্ছে সৌখিন ধাতব পোল। আর পুরনো ব্যারিকেড থেকে শুরু করে সহস্রাধিক বাতিল কংক্রিটের চাঁই ক্রেনে করে নিয়ে এসে জড়ো করা হয়েছিল সান ফ্রান্সিসকোর গোল্ডেন গেট পার্কে।
ঠিক সেভাবেই এই পার্কে এসে হাজির হয়েছিল ফুট চারেক লম্বা একটি বেলনাকার ট্রাফিক ব্যারিকেড। এক সন্ধে বেলায় সেটিকে পার্কে নামিয়ে গিয়েছিলেন কর্মরত ক্রেন-ম্যান জিম ওয়াফোর্ড। কিন্তু মাস কয়েকের মধ্যেই বদলে যায় গোটা ছবিটা। সিঁদুর-হলুদ দিয়ে তিলক আঁকা হয় ব্যারিকেডটির গায়ে। সেইসঙ্গে সাদা রং দিয়ে তৃতীয় নয়নের প্রতিকৃতি। ফুল, ধূপ, ধুনো থেকে শুরু করে ফলমূল, দুধ, মধু— নানা অর্ঘ্যের সমাহার তার সামনে। শুরু হয় জল ও দুধ দিয়ে মূর্তিটিকে নিয়মিত স্নানও করানোর রেওয়াজ। হ্যাঁ, রাতারাতি এই পাথরের টুকরো হয়ে উঠেছিল শিবলিঙ্গ।
হঠাৎ উপস্থিতি জানান দেওয়া গোল্ডেন গেট পার্কের এই শিবলিঙ্গ নিয়ে রীতিমতো খবর ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা সান ফ্রান্সিসকোয়। এমনকি আমেরিকার বিভিন্ন প্রদেশ থেকেও ঈশ্বর-দর্শনের আশায় ছুটে আসতেন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। প্রতি সোমবার করে হিন্দু ভক্তদের ঢল নামত এই পার্কে। শেষ পর্যন্ত বাসুল পারেক নামে এক প্রবাসী ভারতীয় প্রথমে রহস্যোদ্ঘাটন করেন এই মূর্তির। পরবর্তীতে তা নিশ্চিত করেন ক্রেন-ম্যান জিম ওয়াফোর্ড। তবে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর জিন নিজেও প্রাথমিকভাবে চিনতে পারেননি এই ‘মূর্তি’-কে।
তবে এখানেই শেষ নয়। গোল্ডেন গেট পার্কের শিবঠাকুরের জনপ্রিয়তা এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে ৯০-এর দশকের শেষের দিকে পার্কের মধ্যেই মন্দির স্থাপনের জন্য মার্কিন প্রশাসনের কাছে আবেদন করেন ভক্তরা। সেই আবেদন অবশ্য পত্রপাঠ খারিজ করে দিয়েছিল সান ফ্রান্সিসকো সরকার। পরবর্তীতে গোল্ডেন গেট পার্ক থেকে সরিয়ে ফেলা হয় ‘লর্ড শিবা’-খ্যাত ট্রাফিক পোলটিও।
যদিও এই কাজ খুব একটা সহজ হয়নি খোদ মার্কিন প্রশাসনের ক্ষেত্রেও। সেসময় সরব হয়েছিলেন মার্কিন শিবভক্তরা। তবে উপায়? ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করার ধৃষ্টতা দেখায়নি সান ফ্রান্সিসকো সরকার। পাথরের ব্যারিকেডটি ধ্বংস করে ফেলার বদলে তা স্থানান্তরিত করা হয় সানসেট ব্লকের একটি ভাস্কর্য শিল্পীর স্টুডিও-তে। সংশ্লিষ্ট ভাস্কর ও সান ফ্রান্সিসকো প্রশাসনের মধ্যস্থতায় ঠিক হয়, চাইলে সেখানে গিয়ে দেবদর্শন করতে পারবেন ভক্তরা। তবে এই হঠাৎ বাসাবদলই যেন জনপ্রিয়তা কমিয়ে দেয় গোল্ডেন গেট পার্কের শিবঠাকুরের। ভক্তরা যে তাঁর দর্শন পেতে সানসেটে আর যান না, এমনটা নয়। তবে সেই সংখ্যা হাতে গোনাই…
Powered by Froala Editor