টরোন্টোর সান্তা ক্লজই যখন সিরিয়াল কিলার

লাল জামা-প্যান্ট, মাথায় লাল টুপি। সাদা দাড়ির মধ্যে লুকিয়ে থাকা সদা-হাস্যময় একটা মুখ। হ্যাঁ, সান্তা ক্লজ (Santa Claus) সাজাই ছিল তাঁর পেশা। ডিসেম্বর পড়লেই কানাডার টরোন্টো শহরের একটি শপিং মলে তাঁকে দেখা যেত এই ভূমিকায়। অথচ কে-ই বা জানত, এমন ‘মায়াবী’ সাজের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে এক ঘাতক?

ব্রুস ম্যাকআর্থার (Bruce McArther)। টরোন্টোর (Toronto) গে ভিলেজের এই বাসিন্দা পেশায় একজন মালি এবং সান্তা ক্লজ হলেও, নেশায় তিনি পুরোদস্তুর খুনি। সিরিয়াল  কিলার। ২০১৭ সালের কথা। টরোন্টোর এই শপিং মলের সামনে থেকেই পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল তাঁকে। তখনও সান্তার পোশাকেই ছিলেন তিনি। তারপর প্রকাশ্যে এসেছিল তাঁর এই রহস্যময় ‘দ্বিতীয়’ জীবনের কাহিনি। এবার কানাডার এই কুখ্যাত সিরিয়াল কিলারকে নিয়ে তৈরি হল আস্ত একটি তথ্যচিত্র ‘সান্তা ক্লজ দ্য সিরিয়াল কিলার’। 

ম্যাকআর্থারের এই খুনে ঘটনার কাহিনির শুরু হয় ২০১০ সাল থেকে। সে-বছরই তাঁর প্রথম শিকার হয়েছিলেন সেলিম এসেন নামের এক ব্যক্তি। তারপর ক্রমশ বেড়েছে সংখ্যাটা। ২০১৭ সালে পরিসংখ্যান গিয়ে পৌঁছেছে ৮-এ। মজার বিষয় হল, এই ৭ বছরের ব্যবধানে তাঁর সঙ্গে পুলিশের এনকাউন্টার হয়েছে একাধিকবার। তবে, তা সত্ত্বেও তাঁর নাগাল পাননি পুলিশ। শেষ পর্যন্ত, তাঁর হাতে থেকে ফস্কে যাওয়া নবম শিকারের দৌলতেই ২০১৭ সালে তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। কিন্তু একজন ঘাতককে গ্রেপ্তার করতেই এত বছর সময় লাগল কেন পুলিশের?

সিরিয়াল কিলিং-এর তদন্তের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হল, ঘাতকের মোটিফ বা উদ্দেশ্য বোঝা। ব্রুসের এক্ষেত্রে সেই মোটিফটা চিহ্নিত করতেই দীর্ঘ সময় লেগে যায় পুলিশের। আসলে, তাঁর শিকার হওয়া মানুষরা সকলেই ছিলেন সমকামী। আরও বিশেষভাবে বলতে গেলে, মধ্য এবং দক্ষিণ এশিয়ার অভিবাসী বাসিন্দা। যাঁদের স্রেফ দেশ ছাড়তে হয়েছিল সমকামী হওয়ার কারণে। তাই টরোন্টো শহরে ‘গে ভিলেজ’-এ এসে বসবাস শুরু করলেও, তাঁদের আসল পরিচয় সচরাচর সামনে আনতেন না তাঁরা। অন্যদিকে বাড়ির লোকজন ও আত্মীয়দের তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বহু আগেই। তাই নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ায় তাঁদের তরফ থেকেও সে-ভাবে কোনো তদন্তের আর্জি জানানো হয় পুলিশের কাছে। ফলে, সার্বিকভাবে পুলিশের পক্ষে সূত্রের কূলকিনারা করাই কঠিন হয়ে উঠেছিল বেশ। 

অবশ্য ২০১১ সালে তাঁর দ্বিতীয় শিকার নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার সময়ই টরোন্টো পুলিশের ইনস্পেকটর ম্যারি ক্যাথরিন ম্যাসকট সন্দেহ করেছিলেন এই ঘটনা আসলে সিরিয়াল কিলিং। কোনো ব্যক্তি কেবলমাত্র এশিয় পুরুষদেরই অপহরণ করছেন ধারাবাহিকভাবে। কিংবা গোপনে খুন করে লুকিয়ে রাখছেন তাঁদের দেহ। তদন্তের পর তাঁর জমা দেওয়া চার্জশিট নিয়ে হাসির রোল উঠেছিল সে-সময়। তবে প্রতিবছর একের পর এক ঘটনাই ফের নজর কাড়ে পুলিশের। নতুন করে শুরু হয় তদন্ত। বেশ কয়েকবার ফাঁদ পাতা হলেও, পুলিশের নাকের ডগা দিয়েই পালিয়ে যান ব্রুস। 

২০১৭ সালে ব্রুসের শিকার হতে হতেও প্রাণে বাঁচেন শন ক্রিবিন নামের এক ব্যক্তি। তিনিই থানায় এসে জানান গোটা ঘটনাটি। তাঁর স্মৃতি শক্তির ওপর ভিত্তি করেই তৈরি করা হয় ব্রুসের ছবি। প্রথমবারের জন্য সামনে আসে তাঁর খুন করার পদ্ধতির বৃত্তান্তও। 

ভুয়ো নাম ব্যবহার করেই ডেটিং অ্যাপের মাধ্যমেই সমকামীদের আকৃষ্ট করতেন ব্রুস। তারপর সঙ্গমের জন্য আহ্বান জানাতেন তাঁদের। তবে হোটেল কিংবা নিজের বাড়ি নয়, কোনো রেস্তোরাঁয় খাওয়া-দাওয়ার পর অনেকটা ক্যাম্পিং-এর ধাঁচেই তাঁদের নিয়ে যেতেন নির্জন এলাকায়। ব্যবহার করতেন ‘গামা-হাইড্রক্সিবিউটারিক অ্যাসিড’ বা ‘জিএইচবি’ নামের একটি বিশেষ চেতনানাশক ড্রাগ। অবশ্য এই ওষুধ নিষিদ্ধ নয়। বিশেষত কানাডায় যৌনতা সংক্রান্ত যন্ত্রণা লাঘব করতে বহুলভাবে ব্যবহৃত হয় এটি। এই ওষুধ খাওয়ানোর পরই, মুখে টেপ বেঁধে শিকারদের ছবি তুলতেন তিনি। তারপর ধর্ষণ ও খুন।  

শন ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করতেন না জিএইচবি ড্রাগের ব্যবহার। তবে ‘সঙ্গী’-র অনুরোধ রাখতে এই ওষুধ মুখে নিলেও, তা সুযোগ বুঝেই ফেলে দেন তিনি। ফলে চেতনানাশ না হওয়ায়, ব্রুসের নৃশংসতার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী হয়েছিলেন তিনিই। ওষুধ না খাওয়ায়, পালিয়ে প্রাণ বাঁচানোর সুযোগও জোটে তাঁর। 

২০১৭ সালে ব্রুসকে গ্রেপ্তারের পর সামনে আসে একের পর এক খুনের প্রমাণ। ল্যাপটপের হার্ডডিস্ক থেকে পাওয়া যায় তাঁর শিকার হওয়া মানুষদের নৃশংস সব ছবি। তাছাড়াও একটি পাবলিক পার্কের বিভিন্ন গাছের নিচ থেকে পাওয়া যায় মৃতদের দেহাবশেষ। তাছাড়া ব্রুস নিজেও স্বীকার করেন, বিবাহবিচ্ছেদের পর দৈহিক চাহিদা মেটাতেই তাঁকে বাধ্য হতে হয়েছিল সমকামী হতে। তবে সমকামিতার প্রতি তাঁর নাকি ‘ঘেন্না’ ছিল শুরু থেকেই। তাই সঙ্গমের পর নিজের বিচারে ‘শাস্তি’ দিতেন তিনি। 

একাধিক প্রথম ডিগ্রি হত্যার অপরাধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হলেও, ব্রুসের এই রিপোর্ট সম্পূর্ণভাবে সে-সময় প্রকাশ্যে আনেনি টরোন্টো পুলিশ। এবার প্রায় অর্ধ দশক পর, সেই নৃশংস গল্প ফুটে উঠল বিবিসির তথ্যচিত্রে…

Powered by Froala Editor