মেটালিকা বনাম তালিবান, অভিনব সঙ্গীতযুদ্ধের সাক্ষী ছিল আফগানিস্তান

সত্তর-আশির দশকের কথা। ততদিনে দুটো বিশ্বযুদ্ধ দেখা হয়ে গেছে পৃথিবীর। ঘনিয়ে এসেছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। হ্যাঁ, তৎকালীন আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি ইঙ্গিত দিত তেমনটাই। ক্রমাগত হুমকি, প্রতিহুমকির আদানপ্রদান চলছে বিশ্বের অন্যতম দুই শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েতের মধ্যে— ঠান্ডা যুদ্ধ। সেইসঙ্গে বিশ্বের একাধিক দেশে যুদ্ধ তো চলছেই। আশির দশকে এই যুদ্ধ-পরিস্থিতি হয়ে উঠেছিল পাশ্চাত্য সঙ্গীতের বিষয়বস্তু। বিশেষ করে মেটাল ব্যান্ড ‘মেটালিকা’ তাদের গানের মধ্যে দিয়ে রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছিল গোটা বিশ্বে। কিন্তু শুধুই কি মানুষের চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করা? না, খোদ যুদ্ধক্ষেত্রেও হাজির হয়েছিল মেটালিকা (Metallica)।

হ্যাঁ, অবাক লাগলেও সত্যি। যুদ্ধক্ষেত্রেও ‘লড়েছে’ কিংবদন্তি মার্কিন ব্যান্ডটি। তাও যে-সে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নয়। খোদ তালিবানের (Taliban) বিরুদ্ধে। 

একুশ শতকের একদম শুরুর দিক সেটা। অকুস্থল আফগানিস্তান। সরকারকে উচ্ছেদ করে অনেক আগেই কাবুলের দখল নিয়েছে তালিবানরা। অন্যদিকে আফগানিস্তানের পাশে দাঁড়িয়েছে ন্যাটো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তি। দীর্ঘ ৫-৬ বছর ধরে যুদ্ধ চললেও, যেন কোনোভাবেই মোকাবিলা করা যাচ্ছে না তালিবদের। সেইসঙ্গে একের পর এক ধ্বংসের খাতায় নাম লেখাচ্ছে আফগানিস্তানের ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন ঐতিহাসিক নিদর্শন। ঠিক এমন মুহূর্তেই রণাঙ্গনে নেমেছিল মেটালিকা। ‘gun’-এর বদলে গানই হয়ে উঠেছিল যুদ্ধের হাতিয়ার। নেপথ্যে মার্কিন বাহিনী।

খুলেই বলা যাক সেই গল্প। ১৯৯৬ সালেই আফগানিস্তানে কায়েম হয়েছিল তালিবানরাজ। আর তারপরেই দেশজুড়ে জারি হয়েছিল শরিয়ৎ আইন। অনেক বিষয়ের মতোই, কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় সঙ্গীতের ওপর। এমনকি গাইলে বা গান শুনলে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তিও পেতে হত আফগান মানুষদের। তালিবানদের বিশ্বাস, ধর্মমতে গান শোনা পাপ। সেটাই এই ফতোয়াজারির একমাত্র কারণ। 

আরও পড়ুন
অ্যালবামের কভারে নগ্ন শিশুর ছবি, নিরভানার ‘নেভারমাইন্ড’ নিয়ে বিতর্ক কাটেনি আজও

সঙ্গীতের প্রতি তালিবানদের এই স্পর্শকাতরতাকেই হাতিয়ার করে নিয়েছিলেন মার্কিন সেনারা। গান শুনিয়ে তালিবানদের আফগানিস্তান থেকে দূর করতে চেয়েছিলেন তাঁরা। তবে যে সে গান নয়, পাশ্চাত্যের ‘কড়া’ রক এবং মেটাল সঙ্গীত। আর তার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল মেটাল ব্যান্ড মেটালিকাকে। তাছাড়াও প্লে-লিস্টে ‘দ্য অফস্পিরং’, ‘থিন লিজি’-র মতো ব্যান্ডের নামও। তবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হত মেটালিকাই। আর এই গোটা পরিকল্পনাটা ছিল ইউএস মেরিন কর্পসের এক সেনাপ্রধানের মস্তিষ্কপ্রসূত। 

আরও পড়ুন
প্রথম ব্যান্ড হিসাবে 'সপ্ত মহাদেশ-জয়', আজও অক্ষুণ্ণ মেটালিকার গিনেস রেকর্ড

‘সাই-অপস’ বা সাইকোলজিক্যাল অপারেশন। এমনই নাম ছিল এই অভিযানের। আফগানিস্তানের হেলমান্দ প্রদেশে রীতিমতো সাফল্যও পেয়েছিল এই মনস্তাত্ত্বিক অপারেশন। যুদ্ধ ক্ষেত্রে ট্যাঙ্ক, মিশাইল ও অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্রের পাশাপাশি বিশালাকার ট্রাকে করে স্পিকার নিয়ে হাজির হতেন মার্কিন সেনারা। তারপর তারস্বরে চলত রক বা মেটাল-সাধনা। এক থেকে দেড় মাইল দূর থেকে শোনা যেত সেই আওয়াজ। এবং আশ্চর্যের বিষয় হল, সেই গান শুনেই হুলুস্থুল পড়ে যেত তালিবানদের মধ্যে। সেনাবাহিনীর অনুপ্রবেশের আগেই গ্রাম ছেড়ে পালাতেন তালিব যোদ্ধারা। 

আরও পড়ুন
মঞ্চে উঠতে দেননি ডিলান, অপমানিত জোন বায়াজ বেরিয়ে এলেন সম্পর্ক থেকেও

অবশ্য খুব বেশিদিন লড়তে হয়নি মেটালিকাকে। একুশ শতকের শুরুর দিকেই ক্ষমতাচ্যুত হয় তালিবানরা। সেইসঙ্গেই বন্ধ হয় সেনাবাহিনীর ‘মেটাল সম্প্রচার’ও। 

বিশ্বের একমাত্র ব্যান্ড হিসাবে সপ্তমহাদেশ জয়ের রেকর্ড রয়েছে মেটালিকার পকেটে। গ্র্যামি তো বটেই, তাছাড়াও রয়েছে রয়েছে অজস্র অজস্র পুরস্কার। কিংবদন্তিও কম নেই। এসবের বাইরে সত্যিকারের ‘যুদ্ধজয়’-র পালক আর কটি ব্যান্ডের মুকুটেই বা রয়েছে? রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘আমি হাত দিয়ে দ্বার খুলব নাগো, গান দিয়ে দ্বার খোলাব…’ বাস্তবে যেন সেই কাজটাই করেছিল ক্যালিফোর্নিয়ার কিংবদন্তি মেটাল ব্যান্ডটি…

Powered by Froala Editor

More From Author See More