কোনো দেশ গ্রুপ পর্ব থেকে নক-আউট পর্বে ছাড়পত্র পাবে কিনা, তা নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট গ্রুপের প্রতিদ্বন্দ্বীদের পয়েন্টের ওপরও। চলতি বিশ্বকাপের গ্রুপ ই-এর কথাই ধরে নেওয়া যাক। প্রথম ম্যাচেই জাপানের কাছে হেরে বিপাকে পড়েছিল জার্মানি। শেষ ম্যাচে চমকপ্রদ প্রত্যাবর্তন করলেও অধরাই থেকে যায় জার্মানির নক-আউটে ওঠার স্বপ্ন। পরবর্তী রাউন্ডে পৌঁছে যায় গোল পার্থক্যে এগিয়ে থাকা স্পেন।
শুধু আজ নয়, বিশ্বকাপের মঞ্চে এই জটিল সমীকরণের খেলা দেখা গেছে আজীবন। এমনকি গোল পার্থক্য কমিয়ে নক-আউট পর্বের ছাড়পত্র পাওয়ার জন্য রীতিমতো মাঠ ছাড়তে বসেছিল গোটা দল, এমন নজিরও আছে বিশ্বকাপের ইতিহাসে। কথা না বাড়িয়ে সেই গল্পের পাতাতেই ফিরে যাওয়া যাক বরং।
১৯৮২ সাল। সেবারই প্রথমবারের জন্য বিশ্বকাপে (World Cup) জায়গা পেয়েছে কুয়েত (Kuwait)। এমনকি একমাত্র দেশ হিসাবে এশিয়া জোনের প্রতিনিধিত্বও করেছিল এই গালফ দেশটি। তবে লড়াই খুব একটা সহজ ছিল না মোটেই। গ্রুপ পর্বে মুখোমুখি হতে হয়েছিল তিন হেভিওয়েট দলের— ফ্রান্স (France), চেকোস্লোভাকিয়া এবং ইংল্যান্ড।
প্রথম ম্যাচেই চেকোশ্লোভাকিয়ার সঙ্গে ড্র করে কুয়েত। অন্যদিকে ৩-১ গোলে ইংল্যান্ডের কাছে পরাজিত হয় ফ্রান্স। ইংল্যান্ড ২-০ গোলে হারায় চেকোস্লোভাকিয়াকেও। ফলে গ্রুপ পর্বে টিকে থাকার আশা জেগে থাকে কুয়েতের। দ্বিতীয় ম্যাচে ফরাসিদের রুখে দিতে পারলেই বদলে যেত গ্রুপের গোটা সমীকরণ।
তেমন পরিকল্পনা নিয়েই মাঠে নেমেছিল মধ্যপ্রাচ্যের দেশটি। তবে ফ্রান্সের মুহুর্মুহু অ্যাটাকারের সামনে তাসের ঘরের মতো ধ্বসে পড়ে কুয়েতের ডিফেন্স। একটি গোল খেলেও পর পর ৩টি গোল শোধ করে ফ্রান্স। তবে এই ফলাফল ধরে রাখতে পারলেও গোল পার্থক্যের সৌজন্যে কুয়েতের কাছে সুযোগ ছিল নক-আউটে পৌঁছানোর। তবে ম্যাচের ৯০ মিনিটে ঘটে যায় এক অদ্ভুত ঘটনা।
দূর থেকে বাড়ানো থ্রু বল ধরে কুয়েতের বক্সে ঢুকে গিয়েছিলেন ফরাসি স্ট্রাইকার গিরেসে। দু’জন কুয়েতের খেলোয়াড়কে কাটিয়ে আরও খানিকটা এগিয়ে যাওয়ার পরই বেজে ওঠে বাঁশি। মুহূর্তে থেমে যান সকল খেলোয়াড়রা। তবে গিরেসে থামেননি। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বল ঠেলে দেন কুয়েতের জালে। ইউক্রেনিয়ান রেফারি মিরোস্লাভ স্টুপারের নির্দেশে বদলে যায় ম্যাচের স্কোরবোর্ড। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে, রেফারির বাঁশি বাজানোর পরেও কি খেলা চালিয়ে যাওয়া যায় নাকি? তবে এই গোল তো বাতিল হওয়ার কথা।
আসলে, রেফারি নয়, যে-বাঁশি শুনে কুয়েতের সকল খেলোয়াড়রা খেলা থামিয়ে দিয়েছিলেন, সেই বাঁশি বেজেছিল হোসে জোরিলা স্টেডিয়ামে। আর দর্শকের বাজানো সেই বাঁশিতেই বিভ্রান্তির জন্ম। ডিফেন্ডাররা ভেবেছিলেন হয়তো অফসাইড দিয়েছেন রেফারি। এরপর নাটকীয় মোড় নেয় পরিস্থিতি। মাঠে নেমে আসেন কুয়েত ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট শেখ ফাহিদ আল-সাবাহ। মাঠের মধ্যেই শুরু হয় বিক্ষোভ। দুই দলের কোচ এবং খেলোয়াড়দের মধ্যেও লেগে যায় বাকবিতণ্ডা। তাতে কোনো লাভ না হওয়ায় মাঠ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন কুয়েত ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট। এমনকি মাঠ ছেড়ে সাইডলাইনে চলেও এসেছিলেন কুয়েতের সমস্ত খেলোয়াড়। শেষ পর্যন্ত এই প্রতিবাদের জেরে গোল প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন রেফারি। ড্রপ-বলের মাধ্যমে ৩-১ স্কোরলাইনেই ফের শুরু হয়েছিল ম্যাচ। অবশ্য এই ম্যাচ শেষের পর ফিফা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে ম্যাচের ফলাফল ৪-১। এমনকি আজও পুরনো নথিতে এই ম্যাচের ফলাফল নথিভুক্ত রয়েছে ৪-১ হিসাবেই। এই জয়ের সুবাদেই ফ্রান্স শেষ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল পরবর্তী রাউন্ডে।
অন্যদিকে সেই বিশ্বকাপের জন্য বরখাস্ত হন ম্যাচ রেফারি মিরোস্লাভ স্টুপার। এমনকি আর কোনোদিন বিশ্বকাপ ম্যাচ পরিচালনার সুযোগ পাননি তিনি। কুয়েত ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট শেখ ফাহিদকেও মোটা টাকা জরিমানা দিতে হয় ম্যাচ চলাকালীন মাঠে অনুপ্রবেশ করার জন্য। সে-সময় বিশ্বজুড়ে খুব চর্চাও চলেছিল তাঁকে নিয়ে।
এই ঘটনার ঠিক ৮ বছর পর, ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপের ঠিক আগে ৮২-র ফরাসি ক্যাপ্টেন প্ল্যাটিনিকে নিজের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানান শেখ ফাহিদ। বিশ্বকাপের ময়দানে তাঁর আচরণের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনাও করেছিলেন তিনি। এই ঘটনার মাস কয়েকের মধ্যে মৃত্যু হয় প্রাক্তন কুয়েতি ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্টের। ইরাক ও কুয়েতের যুদ্ধে প্রাণ হারান তিনি। আজও বিশ্বকাপের অন্ধকার ইতিহাসের কথা উঠলেই চর্চায় উঠে আসেন শেখ ফাহিদের নাম। কিন্তু ক-জনই বা মনে রেখেছে তাঁর ক্ষমাপ্রার্থনার কথা?
Powered by Froala Editor