গতকালই বাঁশি বেজেছে ফুটবল বিশ্বযুদ্ধের। শুরু হয়ে গেছে ৩২ দেশের জাত্যাভিমানের লড়াই। উন্মাদনার এতটুকু অভাব নেই ভারতেও। ফুটবল বিশ্বকাপ শুরুর আগে থেকেই মেসি, রোনাল্ডো, নেইমার কিংবা এমবাপের সমর্থনে গলা ফাটাচ্ছেন এদেশিয়রা। সোশ্যাল মিডিয়ায় চলছে তুমুল চর্চা-সমালোচনা। কিন্তু এই আবেগ-তরঙ্গের স্রোতেই বার বার ফিরে আসে এক অস্বস্তিকর প্রশ্নও। ফুটবল বিশ্বকাপের (FIFA World Cup) স্টেডিয়ামে কি কোনোদিনও উড়বে ভারতের (India) তেরঙা? স্কোরবোর্ডে দেখা যাবে ভারতের নাম?
এখনও পর্যন্ত এই প্রশ্নের উত্তর অধরাই সকলের কাছে। এমনকি ফিফার ক্রমতালিকায় প্রথম একশো দেশের মধ্যেও নিজের জায়গা পাকা করতে পারেনি ভারত। তবে এই ‘পোড়া দেশ’-এরও একবার সুযোগ মিলেছিল বিশ্বকাপ খেলার। ব্রাজিল, ইংল্যান্ড কিংবা উরুগুয়ের মতো দেশের বিরুদ্ধে মাঠ দাপানোর। তবে সমস্ত প্রস্তুতির পরও শেষ পর্যন্ত অধরাই থেকে যায় ভারতের বিশ্বকাপ অভিযান।
কথা হচ্ছে ১৯৫০-এর ব্রাজিল বিশ্বকাপ নিয়ে। ১৯৫০-এর বিশ্বকাপকে অঘটনের বিশ্বকাপ বললেও যেন কম বলা হয়! ফুটবল ইতিহাসের একমাত্র ফাইনালহীন এই বিশ্বকাপে ফেবারিট ব্রাজিলকে টপকে অঘটন ঘটিয়েছিল উরুগুয়ে। আর এই বিশ্বকাপ শুরুর ঠিক আগে, যোগ্যতা অর্জন করেও স্রেফ মাঠে না নামার সিদ্ধান্ত নেয় ভারত।
১৯৪৮ সাল। সদ্য দেশ স্বাধীন হয়েছে। প্রথমবারের জন্য স্বাধীন দেশ হিসাবে অলিম্পিকে অংশ নিয়েছিল ভারত। মুখোমুখি ইউরোপের অন্যতম ফুটবল-শক্তি ফ্রান্স। অথচ সেই ফ্রান্সকেই ৮৯ মিনিট পর্যন্ত ১-১ গোলে আটকে রেখেছিল ভারত। শেষ অবধি ২-১ ব্যবধানে হারলেও, গোটা বিশ্বের নজর কাড়ে দারিদ্র, রাজনৈতিক টালবাহানা, হিংসায় জর্জরিত সদ্য-স্বাধীন এই দেশের ফুটবলারদের লড়াই। শুধু ফুটবল নয়, জাতীয়তাবাদ, জাত্যাভিমানের যুদ্ধও বটে। আর সেই লড়াইয়ে সফলও হয়েছিলেন ভারতীয়রা। ডাক এসেছিল খোদ ব্রিটিশ রাজ দরবার থেকে। বাকিংহাম প্যালেসে রাজা ষষ্ঠ জর্জ আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন গোটা দলকে।
এই ঘটনার পরই বিশ্ব ফুটবলের চর্চায় রীতিমতো উঠে আসে ভারতের নাম। অন্যদিকে তখন শুরু হয়ে গেছে বিশ্বকাপের প্রস্তুতি। ১৯৪২, ১৯৪৬— বিশ্বযুদ্ধের কারণে পর পর দু’বার বিঘ্নিত হয়েছে বিশ্বকাপের আয়োজন। কাজেই ফুটবল বিশ্বকাপে নতুন করে চমক আনার পরিকল্পনা করেছে ফিফা। কিন্তু আন্তর্জাতিক এই টুর্নামেন্ট আয়োজনে হাত গুটিয়ে নিল ইউরোপ। কারণ, বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত সেরে ওঠেনি তখনও। শিয়রে অর্থনৈতিক মন্দা। শেষ পর্যন্ত আয়োজনের দায়িত্ব বর্তাল ব্রাজিলের কাঁধে।
ঠিক হয়েছিল অংশ নেবে ১৬টি দেশ। তবে কাপ শুরুর আগেই গণ্ডগোল দেখা দিল সেই হিসাবে। ইউরোপ থেকে হাজির হবে ৮টি দেশ। অংশ নেবে ব্রাজিল-সহ লাতিন আমেরিকার আরও ৭টি ফুটবল পাওয়ার-হাউস। আর বাকি একটি শূন্যস্থান? আসলে, বিশ্বযুদ্ধের কারণে একঘরে হয়েছে জার্মানি ও জাপান। তারা ‘নিষিদ্ধ’ বিশ্বকাপ থেকেও। আর সেখানেই সমস্যা। শেষ অবধি ঠিক হল, এই শূন্যস্থান পূরণ করবে এশিয়ার একটি দেশ। তবে একটি নয়, সব মিলিয়ে বাছাই পর্বের জন্য চারটি দেশের কাছে আমন্ত্রণপত্র পাঠিয়েছিল ফিফা।
১৯৪৮-এর অলিম্পিকের সুবাদেই ভারতও ছিল এই চার দেশের তালিকায়। তবে অন্য তিন দেশ ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন ও মায়ানমার অংশগ্রহণে রাজি না হওয়ায়, সরাসরি বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন করে ভারত। ১৬ মে, ১৯৫০। ঘোষণা হয়ে গিয়েছিল ভারতের জাতীয় দলও। ভারতের প্রথম ম্যাচ রাখা হয়েছিল ২৮ জুন। তবে ব্রাজিল পাড়ি দেওয়ার আগেই ফের বদলে যায় সমীকরণ। ফিফার সঙ্গে শুরু হয় এআইএফএফ-এর বিতর্ক। ব্যাপার কী?
ভারতের তরফে সাফ জানানো হয়, খালি পায়ে খেলতেই অভ্যস্ত ভারতীয়রা। অন্যদিকে ফিফার নিয়ম, বাধ্যতামূলকভাবেই বুট পরেই খেলতে হবে বিশ্বকাপের ময়দানে। এই বিতর্কের পরই বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া থেকে পিছিয়ে আসে ভারত। সামনে রাখা হয়েছিল ফুটবলার খালি পায়ে খেলার দাবিকেই। তবে চাইলে এআইএফএফ কি সত্যিই নিয়ম করে তাঁদের বুট পরতে রাজি করাতে পারত না?
হ্যাঁ, পারত। এ-ছিল কেবলই অজুহাত-মাত্র। ভারতীয় খেলোয়াড়রা বুট পরে খেলতে রাজি হলেও, ব্রাজিলে ভারতের যাওয়া হয়ে উঠত কিনা সন্দেহ রয়েছে তা নিয়ে। কারণ, ব্রাজিল সফরের জন্য কোনো তহবিল তৈরির চেষ্টাই করেনি এআইএফএফ। এমনকি ফুটবল বিশ্বকাপের গুরুত্ব ঠিক কতটা— সে-ব্যাপারেও সুনির্দিষ্ট ধারণা ছিল না ভারতের ফুটবল নিয়ামক সংস্থার কর্মকর্তাদের। জাহাজে চেপে বিশ্বের অপর প্রান্তে পাড়ি দেওয়াকে তাই স্রেফ অর্থহীন বলেই ধরে নিয়েছিলেন তাঁরা।
অন্যদিকে বছর দুয়েক বাদেই হেলসিঙ্কি অলিম্পিক। ১৯৫২ সালের সেই অলিম্পিকই ছিল ভারতের নয়নমণি। ১৯৫১-র এশিয়ান গেমসও তখন শিয়রে। এতগুলো বিদেশ সফর যথেষ্ট ব্যয়বহুল তো বটেই। ভারতের পিছিয়ে আসার মূল কারণ ছিল হয়তো সেটাই। তবে ’৫১-তে এশিয়ান গেমসে ভারত সোনা জিতলেও, হেলসিঙ্কিতে মুখ থুবড়ে পড়েছিল ভারতের স্বর্ণযুগের দল। ফিনল্যান্ডের হিমশীতল মাটিতে খালি পায়ে খেলতে গিয়ে রীতিমতো বিপাকে পড়েছিলেন ভারতীয়রা। আর তারপরই বুট পরে খেলা বাধ্যতামূলক করে এআইএফএফ।
সবমিলিয়ে বিশ্বকাপে না খেলার সিদ্ধান্ত যেন দীর্ঘমেয়াদে বুমেরাং হয়ে ফিরে আসে ভারতের কাছে। নষ্ট হয় ফিফার সঙ্গে সম্পর্কও। অন্যদিকে ’৬২-র এশিয়ান গেমসে সোনা, ’৬৪-র এশিয়া কাপে রানার্স হয়েও আর কোনোদিন বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ হয়নি ভারতের। ব্রাত্য থেকে গেছেন চুনী, পিকে কিংবা শৈলেন মান্নার মতো স্বর্ণযুগের খেলোয়াড়রা।
তারপর পেরিয়ে গেছে আরও ৭ দশক। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় ফুটবলে বদল এসেছে অনেক। তবে একটু একটু করে পিছিয়েছে দেশের স্থানাঙ্ক। ফুটবলকে ছাপিয়ে ক্রিকেটই হয়ে উঠেছে এ-দেশের খেলা-জগতের স্বর। পরিকাঠামো তৈরির থেকে, সর্বময় কর্তার আসনে বসে খেলাধুলো পরিচালনা এবং সিদ্ধান্ত নেওয়াতেই আগ্রহী দেশের কর্মকর্তারা। তার জন্য ফিফার ‘লাল কার্ড’ তথা ‘নির্বাসন’-এ মুখ দেখতেও দ্বিধা নেই কোনো। আমরা সাধারণ ভারতীয়রাও কি কম দায়ী? যে-ভাবে ইপিএল কিংবা লা-লিগার হয়ে গলা ফাটাই, সেই সমর্থন কি আদৌ পেয়ে থাকেন সুনীল ছেত্রীরা? খেলার পরিকাঠামো এবং অর্থনৈতিক রূপরেখার জন্য ক’জন অভিভাবকই বা খেলাধুলো চালিয়ে যেতে ইন্ধন জোগান তাঁদের সন্তানকে? এই জটিল ধাঁধাঁর সমাধান না মেলা পর্যন্ত কস্মিনকালেও ভারতের ফুটবল বিশ্বকাপ খেলা হবে না, তাতে সন্দেহ নেই কোনো…
Powered by Froala Editor