১৯১৭ সাল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে পুরোদমে। জার্মানির দখলে উত্তর-পূর্ব ফ্রান্সের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। আর সেই অঞ্চল স্বাধীন করার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে ফ্রান্সের সৈন্যরা। তবে কাজটা সহজ ছিল না মোটেই। চেমিন দেস ডেমস উপত্যকার মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থান নিয়েছে জার্মান সৈন্যরা। সেখানেই খোঁড়া হয়েছে প্রকাণ্ড এক সুড়ঙ্গ। তার ভেতরেই রয়েছে তাঁদের গোলা-বারুদ, খাবার-দাবার, যুদ্ধ লড়ার রসদ। অন্যদিকে ফরাসিদের হানা দিতে হচ্ছে খোলা ময়দানের ওপর দিয়ে। এযেন এক অসম লড়াই। তবে শেষ পর্যন্ত এই যুদ্ধে জয় হয়েছিল তাদেরই। সুড়ঙ্গেই জীবন্ত কবর দেওয়া হয়েছিল দু-শতাধিক জার্মান সেনাকে।
১৯১৭ সালের ৪ মে এমনই এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটে গিয়েছিল ফ্রান্সে (France)। কিন্তু কীভাবে শেষ অবধি এই অসম লড়াই জিতেছিল ফরাসিরা? আর যুদ্ধ জেতার পর কেন-ই বা জীবন্ত কবর দেওয়া হয়েছিল জার্মানদের (German Soldiers)?
খুলে বলা যাক এই গোটা গল্পটা। আসলে সেনাবাহিনীর সম্মুখ সমরে এই লড়াই জেতা অসম্ভব, তা ভালোই বুঝে গিয়েছিল ফ্রান্স। আর সেই কারণেই জার্মান সেনাদের সুড়ঙ্গ থেকে বার করে আনতে, দূর থেকে সুড়ঙ্গের মুখে তোপ দাগা শুরু করে ফরাসি সেনারা। তাতে কয়েকজন জার্মান সেনার প্রাণ গেলেও, সার্বিকভাবে খুব একটা ক্ষতি হয়নি। তোপের বিষাক্ত গ্যাস আটকানোর জন্য সুড়ঙ্গের মুখে ব্যবস্থা করা হয়েছিল বিশেষ ব্যবস্থার। তবে জার্মানরা অনুমান করতে পারেনি, তাদের তৈরি মিলিটারি গ্রেড সুড়ঙ্গ ধ্বসে পড়তে পারে ফরাসি তোপবর্ষণে।
হয়েছিল তেমনটাই। ক্রমাগত কামানের গোলা এবং তোপের মুখে ধ্বসে পড়ে সুড়ঙ্গের মুখ। মাটির ৬৪ মিটার গভীরে আটকা পড়ে কয়েকশো জার্মান সেনা। সে-খবর পৌঁছে গিয়েছিল জার্মানির সেনা ছাউনিতেও। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে পৌঁছে যায় বাড়তি সেনা, উদ্ধারকারীদের বিশেষ দল।
সুড়ঙ্গ খুঁড়ে ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে বার করে আনার চেষ্টা হয় আটকে থাকা সৈন্যদের। তবে শুধু সুড়ঙ্গের প্রবেশপথই নয়, ধ্বসে পড়েছিল ভেতরের একাধিক অংশ। ফলে শতাধিক সেনাকে উদ্ধার করা সম্ভব হলেও, ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়েন প্রায় ২০০ সেনা। ততক্ষণে ফরাসি আক্রমণেরও তেজ বেড়েছে। ফলে, যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়তে বাধ্য হয় জার্মান উদ্ধারকর্মীরা। অন্যদিকে জীবিত অবস্থাতেই পাতালঘরে বন্দি হয়ে থাকেন দু-শতাধিক সেনা। তারা কেউ হয়তো প্রাণ হারিয়েছিলেন জল-হাওয়ার অভাবে, কেউ আহত হয়েছিলেন খসে পড়া পাথরে, আবার কেউ নিজের মাথাতেই বন্দুক ঠেকিয়ে চিপেছিলেন ট্রিগার।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভুলে যাওয়া হয় এই সুড়ঙ্গের কথা। শুধু সামরিক ইতিহাসের খাতায় তা নথিবদ্ধ হয়েই রয়ে গিয়েছিল কয়েক দশক। পরবর্তীতে এই ঘটনা নতুন করে সামনে আসার পর সংশ্লিষ্ট সুড়ঙ্গটির অনুসন্ধান শুরু করেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা। উত্তর-পূর্ব ফ্রান্সের চেমিন দেস ডেমস উপত্যকায় শুরু হয় খননকার্য। তাতে ফরাসি সরকার, জার্মানির ওয়ারগ্রেভ কমিশন ‘ভক্সবুন্ড’ ছাড়াও জড়িত ছিল একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তাছাড়া বেআইনিভাবে এই সুড়ঙ্গ খুঁজে বার করার জন্যও বহু খননকার্য চলেছে সংশ্লিষ্ট উপত্যকায়।
২০২১ শেষ পর্যন্ত এই সুড়ঙ্গটিকে চিহ্নিত করতে সফল হন গবেষকরা। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির স্ক্যানার ব্যবহার করে তোলা হয় ছবি। সেখানেই ধরা পড়ে মাটির ৬৪ মিটার বা প্রায় ২১০ ফুট গভীরে শায়িত রয়েছে অসংখ্য মানুষের দেহের অবশিষ্টাংশ। সুড়ঙ্গটি খনন করে মৃত জার্মান সেনাদের দেহাংশ উদ্ধারের চেষ্টা হয়েছিল ঠিকই, তবে তাতে সাফল্য মেলেনি। তার কারণ, সুড়ঙ্গের মধ্যে আটকে থাকা গোলাবারুদ। সামান্যতম ভুলেও ফের বিস্ফোরণ ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে সেখানে। তাছাড়া সুড়ঙ্গ সংলগ্ন বালিমাটিতে ধ্বস নামার সম্ভাবনাও রয়েছে প্রবল।
সম্প্রতি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের এই ঐতিহাসিক নিদর্শনটির সংরক্ষণের জন্য বিশেষ চুক্তিতে স্বাক্ষর করে জার্মান ও ফরাসি সরকার। জানানো হয়, ঐতিহাসিক স্থান হিসাবেই বিবেচিত হবে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলটি। অন্যদিকে সমাধিস্থ জার্মান সেনাদের শ্রদ্ধা জানিয়ে গড়ে তোলা হবে বিশেষ সৌধ। দেশে তাদের দেহাবশেষ না ফিরলেও, ফ্রান্সে কোনোরকম সম্মানের খামতি থাকবে না তাদের জন্য। যুদ্ধ শেষের একশো বছর পেরিয়ে দুই রাষ্ট্রের মধ্যে নতুন করে যেন সম্প্রীতির বার্তা বয়ে আনল এই চুক্তি…
Powered by Froala Editor