ক্রীড়া ঐতিহাসিক ও সমাজতাত্ত্বিকদের পরিভাষায় যাকে বলা হয় ‘গ্লোবাল ফ্যানডম’। অর্থাৎ কলকাতার (Kolkata) বুকে তখন ইতিমধ্যেই ব্রাজিলের (Brazil) বিশাল ফ্যান বেস তৈরি হয়েছিল। কীভাবে এটা সম্ভব হল, তার উত্তর খুঁজতে আমাদের একটু পিছনের দিকে তাকাতে হবে। ‘ফুটবল সম্রাট’ পেলে (Pele) কলকাতা এসেছিলেন আজ থেকে সাড়ে চার দশক আগে, ১৯৭৭ সালে। ‘সিটি অফ জয়ে’ সেই দিনটির প্রতি অদ্ভুত এক অনুরাগ আজও স্পষ্ট। আপনি বিশ্ব ফুটবলের কিছু মার্কি নামের লাইফ সাইজ মাটির কিংবা ফাইবার মূর্তি হরহামেশাই দেখতে পাবেন। বিশেষ করে ফিফা বিশ্বকাপের সময়ে তো কথাই নেই। এই সময় অগণিত ‘ব্রাজিল লেন’ বা ‘আর্জেন্টিনা প্যান্ডেল’ গড়ে উঠতে দেখা যায় আনাচকানাচে। সদ্য বিশ্বকাপ ফুটবল শেষ হয়েছে। তাই এমন সব দৃশ্য সম্প্রতি অনেকের কাছেই টাটকা। যাইহোক, প্রশ্নটা ছিল খাস কলকাতার বুকে ব্রাজিলের অমন বিশাল ফ্যান বেস কীভাবে তৈরি হয়েছিল? সত্তরের দশকের দিকে তাকালে সহজেই এর উত্তর মিলবে। ফুটবল গবেষক শুভ্রাংশু রায় এই প্রসঙ্গে বলছেন, এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের টাইম মেশিনে চেপে পেলের কলকাতায় আবির্ভাব ঘটেছিল যে দশকে, সেই সত্তরের দশকে ফিরে যেতে হবে। আর সত্তরের দশক তো শহরের ফুটবলের দশকও বটে। বাংলাদেশ যুদ্ধ বা স্থানীয় রাজনৈতিক হানাহানি, জরুরি অবস্থা আর ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, রাজ্যের ক্ষমতার পট পরিবর্তনের হাজারো ঝামেলার মধ্যে শহরের যুবক, বৃদ্ধাদের সব উত্তেজনার প্রশমনের সবথেকে বড় জায়গা ছিল গড়ের মাঠ। উত্তেজনা প্রশমন থেকে অবশ্য অন্য উত্তেজনায় মেতে ওঠাই বলা ভালো। কারণ সে-দশকে ’৭০-’৭৫ টানা ছ’বার লিগ জিতে এক অন্য উন্মাদনা তৈরি করেছিল ইস্টবেঙ্গল। ’৭৬ থেকে লড়াইয়ে ফিরে এসেছিল মোহনবাগান। এই সময় স্থানীয় সংবাদপত্রগুলিতে কলকাতার ফুটবলের পাশাপাশি বিদেশি ফুটবলের ছবি-সহ খবর ছাপা শুরু হয়। আলাদা করে খেলার ওপর ম্যাগাজিন প্রকাশ হওয়া শুরু হয়ে যায়, যা কার্যত শহরের জনপ্রিয় সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়েছিল। আবার অমল দত্তের মতো ফুটবল কোচ এবং প্রচারক শহরের অলিগলিতে প্রোজেক্টর লাগিয়ে বড় পর্দায় বিভিন্ন বিদেশি ফুটবল খেলার ক্লিপিংস দেখাতে শুরু করেন। এর মধ্যে বেশিরভাগটাই ছিল সত্তরের ব্রাজিল দল এবং পেলের খেলার ওপর নির্মিত নানান তথ্যচিত্র।
সমর্থক বেস এভাবেই কল্লোলিনীর বুকে গড়ে উঠছিল। ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৭ সালে মোহনবাগান (Mohun Bagan) ক্লাবের বিরুদ্ধে প্রদর্শনী ম্যাচ খেলতে পেলের কলকাতা আসা এতে অন্য মাত্রা যোগ করেছিল। এর তিন বছর আগে, ১৯৭৪-এ পেলে অবসর নিয়ে নিউ ইয়র্কের কসমস ক্লাবের হয়ে খেলছেন। মোহনবাগানের আমন্ত্রণ এসেছে এর মধ্যেই। খবর চাউর হল কসমস ক্লাবের (Cosmos Club) হয়ে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে খেলতে কলকাতা আসবেন পেলে। সাংবাদিক জয়ন্ত চক্রবর্তী তাঁর স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, ‘খবর করা শুরু করলাম। পেলে কোথায় থাকবেন, কী খাবেন, প্র্যাকটিস কোথায় করবেন ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রশ্রয় পেলাম আনন্দবাজার ছেড়ে সদ্য যুগান্তরে আসা বার্তা সম্পাদক অমিতাভ চৌধুরী, ক্রীড়া সম্পাদক অজয় বসু আর সহযোগী ইংরেজি দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকার বার্তা সম্পাদক, হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড থেকে আসা প্রদীপ্ত শঙ্কর সেনের। অমৃতবাজার পত্রিকার সিনিয়র সাংবাদিক অধুনা প্রয়াত অর্ণব ঘোষ ইনটার্ন সাংবাদিকের সঙ্গে কাজে লেগে গেলেন। তাই অবাক হইনি পেলে যেদিন কলকাতায় পা রাখবেন, সেদিন এয়ারপোর্ট কভারিংয়ের দায়িত্ব পাওয়ায়। মনে আছে আমি, যুগান্তরের অগ্রজ সাংবাদিক মনি চক্রবর্তী, বহ্নি রায়, এয়ারপোর্ট করেসপন্ডেন্ট শ্যামাপ্রসাদ সরকার সেদিন রাতে এয়ারপোর্টে ছিলাম। সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিক সেটা। মধ্যরাতে এয়ার ইন্ডিয়ার মাকালু বিমানটি পেলেকে নিয়ে দমদম বিমানবন্দরের টারমাক ছুঁয়েছিল। কাতারে কাতারে লোক, পেলে অনুরাগী সেদিন বিমানবন্দরে হাজির ছিলেন তাঁকে স্বাগত জানানোর জন্য। বিমান রানওয়ের মাটি ছোঁয়ামাত্র রানওয়ের পুলিশের ব্যারিকেড ভেদ করে হাজার হাজার মানুষ ছুটে গিয়েছিলেন মাকালুর উদ্দেশ্যে। পেলেকে একটু ছুঁয়ে দেখার আশায়। সে এক বিশৃঙ্খল অবস্থা। তখন বিমানবন্দরে এত কড়াকড়ি ছিল না। ভিজিটর্স টিকিট কেটে বিমানবন্দরে ঢোকা যেত। পুলিশ লাঠি চার্জ করল। সঙ্গী সাংবাদিক তখনকার ইউএনআই সংবাদ এজেন্সির সাংবাদিক পরে আনন্দবাজার পত্রিকার রূপক সাহা আহত হল। মাকালু থেকে বাস পেলেকে নিয়ে সরাসরি রওনা দিল শহরের উদ্দেশ্যে। বিমানবন্দরে সাংবাদিক সম্মেলন করার কথা থাকলেও তা বাতিল করলেন রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে পেলের সফরের দায়িত্বে থাকা আদ্যন্ত মোহনবাগানি পূর্তমন্ত্রী যতীন চক্রবর্তী। বাসের জানালা দিয়ে পেলের বলা ক’টি কথা আমার পাথেয় ছিল। পেলে সেদিন ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বলেছিলেন, আই লাভ ক্যালকাটা।
পেলের সঙ্গে ওই বিমানেই এসেছিলেন যুগান্তর কাগজের ফ্রিল্যান্স লেখক জ্যোতির্ময় দত্ত। জ্যোতিদার লেখায় মাত হয়েছিল আনন্দবাজার। সেই রাতে আমার একটি ছোট্ট কাজ যুগান্তরের অবজেক্টিভিটি বাড়িয়েছিল। সেদিন পেলের সঙ্গেই আসার কথা ছিল ফ্রাঞ্জ বেকেন বাওয়ারের। সবাই পেলেকে নিয়ে ব্যস্ত ছিল বলে কেউ লক্ষ করেনি ফ্রাঞ্জ বেকেন বাওয়ার আসেননি। বিমানবন্দরকর্মী অকালে প্রয়াতবন্ধু আশীষ ঘোষ আমাকে একটা যাত্রী তালিকা দিয়েছিলেন কসমস ক্লাবের, তাতে বেকেন বওয়ার ছিলেন না। পরদিন সব কাগজে হেডলাইন হল বেকেন বাওয়ারও এসেছেন। যুগান্তরে অমিতাভ চৌধুরী হেডলাইন করলেন পেলের পদার্পণ। পাশে ছোট্ট বক্স আইটেম বেকেন বাওয়ার এলেন না।’ কলকাতায় সেদিন বৃষ্টি নেমেছিল অঝোরে। এই কারণেই একটা অদ্ভুত দ্বিধাদ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল। আদৌ খেলবেন তো পেলে? পেলে মাঠে নামার আগে তাঁর দেহরক্ষী পেড্রো গেরার্ড জয়ন্ত চক্রবর্তীকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছিলেন, পেলে মাঠে নামলেও নিজেকে এক্সার্ট করবেন না। কারণ, পেলের পা ইনসিওর করা আছে ওয়ার্নার ব্রাদার্স-এর কাছে। যুগান্তর পত্রিকায় এই খবর বেরিয়েওছিল। বেরোনোমাত্র হইচই পড়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে, ম্যাচে মোহনবাগান খুব বিশেষ সুযোগ দেয়নি শক্তিশালী কসমসকে। ম্যাচ শেষ হয় ২-২ অমীমাংসিত অবস্থায়। পেলে মাত্র আধঘণ্টা খেলেন। গোলে শট নেন মাত্র তিনটি। এর মধ্যে দু’টি লক্ষ্যের বাইরে ছিল। মাঠে পেলের এমন খেলা দেখে রটে গিয়েছিল এ পেলে নাকি ‘আসল’ পেলে নন। তিনি নাকি যাত্রাপালায় লেনিন, কার্ল মার্কসের চরিত্রে অভিনয় করা শান্তিগোপাল। জয়ন্তবাবু লিখছেন, ‘পেলের বাস-এর সারথীর ইন্টারভিউ সাড়া জাগিয়েছিল। পেলের অন্তরঙ্গ ছবি পাওয়া যাচ্ছিল না। কসমসের হাফ ব্যাক সন্তিআগ ফিরমানির সঙ্গে সুনীলদার ক্যামেরা অদলবদল করার কাহিনি তো কিংবদন্তিতে রূপান্তরিত।’
গ্লোবাল ফ্যানডমের প্রসঙ্গে আরও একটি কথা অবশ্যই বলতে হবে। তা হল প্রবল দারিদ্র্যকে জয় করা পেলের মতো ‘কালো মানুষে’র জীবনকাহিনি মধ্যবিত্তকে এক অন্যরকম অনুপ্রেরণা জোগাত। তাঁর বাবা ছিলেন একজন ঝাড়ুদার। অনটনের এহেন পরিবেশের মধ্যেই ব্রাজিলের সাও পাওলোর রাস্তায় ফুটবল খেলা শুরু করেন পেলে। খিদের জোগান দিতে চায়ের দোকানেও একসময় কাজ করেছিলেন তিনি। দারিদ্র্যের মধ্যে বেড়ে ওঠা পেলের কাছে ফুটবল কেনার মতো সমর্থ ছিল না তখন। এ কারণে মোজায় খবরের কাগজ ভরে দড়ি দিয়ে বেঁধে খালি পায়ে খেলতেন। জন্মের সময় তাঁর নাম রাখা হয়েছিল এডিসন। তাঁর পরিবারের সদস্যরা আদর করে ডাকতেন ডিকো। ফুটবল রক্তেই ছিল। বাবা বড় ব্রাজিলিয়ান ক্লাব ফ্লুমিনেন্সের হয়ে খেলেছিলেন। অর্থের অভাবে ঝাড়ুদারের কাজ বেছে নিতে হয়েছিল তাঁকে। পেলে তাঁর এলাকার স্থানীয় ক্লাব ভাস্কো দা গামার গোলরক্ষক বিলেকে খুব পছন্দ করতেন। তিনি যখন স্কুলে ফুটবল খেলতেন, তখন বন্ধুরা তাঁকে ‘পেলে’ বলে ডাকতে শুরু করে। সেই থেকেই নাম হয়ে যায় পেলে। ১২-১৩ বছর বয়সে পেলে তাঁর শহর বাউরুতে স্থানীয় ক্লাব রেডিয়াম ফুটবল দলের হয়ে খেলা শুরু করেন। তাঁর শহরে প্রথমবারের মতো ফুটসাল অর্থাৎ প্রতি দলে পাঁচজন করে খেলোয়াড়ের মধ্যে একটি ইনডোর টুর্নামেন্ট হয়েছিল। তিনি এই টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছিলেন। এ ছাড়া একটি টুর্নামেন্টের আয়োজক কমিটি তাঁকে অপ্রাপ্ত বয়স্ক বলে অংশ নিতে দেয়নি। তা সত্ত্বেও একপ্রকার প্রায় লড়াই করেই ওই টুর্নামেন্ট খেলেন তিনি। সর্বাধিক গোলও করেন। এখান থেকেই বদলে যায় তাঁর জীবন সংগ্রামের চিত্রনাট্য। এমন সব গল্প হয়তো নিছক ফুটবল মাঠের মধ্যে সীমিত ছিল না। এ নিয়ে বহু নিউজ প্রিন্ট খরচ হয়েছে। অসংখ্য বই প্রকাশিত হয়েছে। আর ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৭-এ পেলে যখন মার্কিন ক্লাব কসমসের হয়ে ইডেন গার্ডেন্সে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে খেলতে এলেন, লক্ষ মানুষ মাঠে রক্তমাংসের ফুটবল সম্রাটকে দেখে রূপকথা লিখতে শুরু করলেন অন্যভাবে।
আরও পড়ুন
ব্রাজিলের ক্লাবে ফুটবল খেলেন মহাত্মা গান্ধী!
কলকাতার মাঠে নামলেন পেলে। এর সঙ্গে জন্ম হল অসংখ্য রূপকথা, অসংখ্য মিথ। টিভির পর্দায় সেদিন সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছিল এই ম্যাচ। পেলের পা থেকে সেদিন বৃষ্টিভেজা মাঠে বল কেড়ে নিয়েছিলেন গৌতম সরকার, সুব্রত ভট্টাচার্যরা। এমন দৃশ্য দেখে বিশ্বাস করতে পারেননি মাঠে উপস্থিত আমজনতা। এবং এই কারণেই বিখ্যাত সেই ‘গুজব’ জন্ম নিয়েছিল, পেলের জায়গায় নাকি মাঠে নেমেছেন যাত্রাশিল্পী শান্তিগোপাল। গবেষক শুভ্রাংশু রায় ‘পেলে ফ্যাক্টর’-এ লিখেছেন, শোনা যায় ময়দানের ‘জ্যাকিদা’ ওরফে যতীন চক্রবর্তী ইডেনে ক্লাব হাউসের সামনে ম্যাচের শেষে এক দল দর্শকের দ্বারা ঘেরাও হয়েছিলেন। যাদের মুখে স্লোগান ছিল ‘জাল পেলে আনলে কেন মন্ত্রী তুমি জবাব দাও’। পেলে ফিরে গেলেন। কিন্তু এ শহরের বুকে জন্ম দিয়ে গেলেন এক জমাটি ব্রাজিল ফ্যান বেস। পেলে আসার পরের বছর থেকে কলকাতাবাসীর রাত জাগা বিশ্বকাপ পার্বণও শুরু হয়ে গেল। ’৮৬-তে মারাদোনা এসে তাতে কিছুটা ভাগ বসালেন বটে, কিন্তু এ শহরে ব্রাজিল সমর্থকদের সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করতে পারলেন না।
আরও পড়ুন
মানসিকভাবে ‘অপ্রস্তুত’ পেলেকে ’৫৮-র বিশ্বকাপ স্কোয়াড থেকে বাদ দেওয়ার পরামর্শ মনোবিদের!
Powered by Froala Editor