ক্যালেন্ডারের ১৯৭২ সাল। আফগানিস্তান তখনও মৃত্যুপুরী হয়ে ওঠেনি। সেখানে তখনও মানুষের প্রাণের উচ্ছ্বাস খেলা করে বেড়ায়। তবে আগুন জ্বলছে ঠিক তার পাশের দেশেই। পাকিস্তানে। সদ্য স্বাধীনতা পেয়েছে বাংলাদেশ। অবশ্য পৃথিবীর অনেক দেশই তখনও বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসাবে মেনে নেয়নি। পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের জন্মলগ্নেই অবশ্য বিদায় নিয়েছে খানসেনার দল। কেউ কেউ আবার ভারত ও বাংলাদেশের কারাগারে বন্দি। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে থাকা বাঙালিরা? তাঁদের অবস্থাও বন্দিদের চেয়ে উন্নত কিছু নয়।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেয়েছে। পাকিস্তানে বন্দি বাঙালিদের মনও তাই ঘরে ফেরার জন্য ব্যাকুল। অথচ ফেরার কোনো উপায় নেই, কারণ পাক সরকারের কাছ থেকে কোনো অনুমতি পাওয়া যাবে না। এর মধ্যেও উপায় খুঁজে নিয়েছিলেন তাঁরা। পাকিস্তানের পূর্ব সীমান্তের কাছাকাছি যাঁদের বাস, তাঁরা সীমান্ত পেরিয়ে চলে আসতে শুরু করেছেন ভারতে। আর পশ্চিম সীমান্তের মানুষরা চলে যাচ্ছেন আফগানিস্তানে। প্রথম রাস্তাটা অবশ্য অনেক বেশি নিরাপদ। মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই সবরকম সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছে ভারত সরকার। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছেন ভারতীয় সেনারাও। কিন্তু আফগান সীমান্তে ধরা পড়লে আর কিছু করার নেই। আর সীমান্ত পেরিয়ে যেতে পারলেও কি সেখানে মাথা গোঁজার বা সেখান থেকে বাংলাদেশে যাওয়ার পথ পাওয়া যাবে?
তবুও প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে সীমান্ত পেরিয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। ১৯৭২ সালের নভেম্বর মাসে নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি প্রতিবেদন থেকে তেমনটাই জানা যাচ্ছে। হ্যাঁ, প্রায় এক বছর আগেই বিজয়দিবস পালন করেছেন মুক্তিযোদ্ধারা। আর এই এক বছরেও উদ্বাস্তু মিছিল বন্ধ হয়নি। নভেম্বর মাসের সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী সেই মাসেই প্রায় ৪০০-৫০০ বাঙালি পাকিস্তান থেকে আফগানিস্তানে প্রবেশ করেছেন। কাবুল ও অন্যান্য শহরে তখন হিপিদের যথেষ্ট যাওয়া-আসা। তাদের জন্য গজিয়ে উঠেছে নানা সস্তার হোটেল। সেই হোটেলেই গাদাগাদি করে জড়ো হচ্ছেন বাঙালিরা। তবে এই সময়ে আফগানিস্তানের শরণার্থী বাঙালিদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল ভারত সরকার। নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন থেকেই জানা যায় সেই খবর।
আফগানিস্তানে আশ্রয় নেওয়া বাঙালিদের থাকা-খাওয়ার যাবতীয় দায়িত্ব নিয়েছিল কাবুলের ভারতীয় দূতাবাস। এমনকি ভারতীয় দূতাবাসের উদ্যোগে তাঁদের জন্য তৈরি হয়েছিল বিশেষ সরকারি পরিচয়পত্রও। এই পরিচয়পত্রের ভিত্তিতেই আফগানিস্তান থেকে বাংলাদেশে ফিরতে পেরেছিলেন সেইসব বাঙালিরা। ভারতীয় দূতাবাসের রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৭২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত মোট ৬ হাজারের বেশি মানুষকে বাংলাদেশ পৌঁছতে সাহায্য করেছেন তাঁরা। না, বাংলাদেশকে তখনও স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেয়নি আফগানিস্তান। কিন্তু বেলুচ সীমান্ত পেরিয়ে এই দেশটাই হয়ে উঠেছিল অসংখ্য বাঙালির কয়েকদিনের আশ্রয়। সেই ইতিহাসের মধ্যেই তো জড়িয়ে আছে এক আত্মীয়তার সুতো।
আরও পড়ুন
প্রাণহানি, অসম্পূর্ণ পড়াশোনা, বন্দিত্ব— তালিবান-জমানায় মহিলাদের ভবিতব্য?
তথ্যসূত্রঃ WAVE OF BENGALIS FLEEING PAKISTAN, New York Times
আরও পড়ুন
মুজতবার ভ্রমণ, নেতাজি-অন্তর্ধান থেকে ‘বাঙালি বউ’-এর হত্যা : কাবুলের বঙ্গ-যোগ
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
তালিবানি আগ্রাসনের মধ্যেই শান্তির স্বপ্নে বুঁদ আফগানিস্তানের মহিলা সাংবাদিক