কোর্ট চত্বরের বাইরে জড়ো হয়েছেন কয়েকশো মানুষ। এজলাসে বিচার (Trial) চলছে গণহত্যাকারীর। একটি-দুটি নয়, সবমিলিয়ে প্রায় ১৪টি খুনের অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। দুই আইনজীবীর যুক্তি-পাল্টা যুক্তির লড়াই চলছে সমানে সমানে। অথচ, সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ নেই অভিযুক্তের। মধ্যাহ্নভোজ সেরে দিব্যি আপন খেয়ালে হাই তুলছে সে!
এমন দৃশ্য দেখলে ‘কোল্ড ব্লাডেড কিলার’ কথাটাই আপনা থেকে চলে আসবে মুখে। তবে এই অভিযুক্ত আসামীটি মানুষ নয়, বরং এক শ্বাপদ। কুকুরের (Dog) বিচার শুনে অবাক লাগছে নিশ্চয়ই? ওই যে রোজ কত কী ঘটে যাহা তাহা… এও তেমনই। আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগের কথা। ১৯২১ সালে মার্কিন এই অদ্ভুত ঘটনার সাক্ষী হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অভিযুক্ত ডরমি নামের কুকুরটির বিচার নিয়ে সাড়া পড়ে গিয়েছিল গোটা দেশে। এমনকি, খুন থেকে শুরু করে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা, এমনকি নির্বাচিত জল্লাদ এবং ডেথ চেম্বারের ছবিও প্রকাশিত হয়েছিল সান ফ্রান্সিসকোর তৎকালীন প্রথম সারির সংবাদপত্র ‘দ্য বাফেলো টাইমস’-এ। দ্বিবিভক্ত হয়ে গিয়েছিল মার্কিন সমাজ। কিন্তু কাদের খুন করেছিল ডরমি (Dormi)?
শুরু থেকেই বলা যাক ঘটনাটা। ১৯২০ সাল সেটা। আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন ডব্লু এল ইনগালস নামের ক্যালিফোর্নিয়ার এক ভদ্রমহিলা। অভিযোগ ছিল তাঁর প্রতিবেশীর এয়ারডেল টেরিয়ার নৃশংসভাবে খুন করেছে তাঁর পোষ্য পারস্যের বিড়াল সানবিম এবং তার তিনটি ফুটফুটে ছানাকে। এমনকি তিনি বিড়ালটিকে বাঁচাতে গেলে, তাঁকেও আক্রমণ করে ডর্মি।
আদালতে এই মামলার শুনানির দিন ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই ক্রমশ বাড়তে থাকে ডর্মির বিরুদ্ধে অভিযোগের তালিকা। আদালতে ডর্মির নামে জমা পড়ে আরও ১০টি খুনের অভিযোগ। সান ফ্রান্সিসকোর তৎকালীন আইনি বিধান অনুযায়ী, শুধুমাত্র অভিযুক্ত পোষ্যই নয় সেইসঙ্গে তাঁর মালিককেও দিতে হবে বড়ো অঙ্কের জরিমানা, ভোগ করতে হবে কারাদণ্ড। প্রাথমিকভাবে তেমনই বিচার দিলেন আদালতের বিচারপতি। ডর্মির মৃত্যুদণ্ডের ইঙ্গিত দিলেন তিনি। তবে এত সহজে কি হার মেনে নেওয়া যায়? চুপ করে বসে থাকলেন না ডর্মির মালিক তথা খ্যাতনামা অটোমোবাইল ডিলার ইটন ম্যাকমিলানও। প্রভাবশালী আইনজীবী জেমস এফ ব্রেনানকে নিয়োগ করলেন তাঁর ডিফেন্ডিং লইয়ার হিসাবে।
আরও পড়ুন
জার্মান শেফার্ডের কবিতাপাঠ! নাৎসি গবেষকদের দৌলতে কুকুরও হয়ে উঠেছিল বাঙ্ময়
আরও পড়ুন
এই সেতুতে এলেই ‘আত্মহত্যা’র চেষ্টা করে কুকুররা, কেন?
বিড়াল গণহত্যার মামলাটির দৌলতে সেসময় দ্বিবিভক্ত হয়ে গিয়েছিল গোটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। খবরের কাগজের প্রথম পাতাতেই থাকত ডর্মি-বিতর্ক। কুকুরপ্রেমী এবং বিড়ালপ্রেমীদের একাধিক সংগঠন তহবিল তৈরিরও উদ্যোগ নিয়েছিল পৃথকভাবে। আর সেই টাকা দিয়েই প্রায় দীর্ঘ এক বছরের বেশি সময় ধরে চলে ডর্মির মামলা। তবে বলাই বাহুল্য, সানবিমের মালকিন স্বয়ং খুনের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হওয়ায় অ্যাটর্নি ব্রেনানের কোনো যুক্তিই ধোপে টেকেনি এজলাসে। এক প্রকার ডর্মির মৃত্যুদণ্ড পাকা হয়ে যাওয়ার পর, শেষ শুনানির দিন তুরুপের তাস চালেন ব্রেনান।
আরও পড়ুন
কুকুরের চিৎকারে বিরক্ত একলব্য, নিক্ষেপ করলেন একসঙ্গে সাতটি তীর!
সেটা ছিল ১৯২১ সালের ২০ ডিসেম্বর। ব্রেনান আদালতে হাজির করেন এয়ারডেল টেরিয়ার ব্রিডের ১০টি কুকুরকে। ইনগালসের দিকে ছুঁড়ে দেন কঠিন পরীক্ষা। তাঁকে এই ১০টির কুকুরের মধ্যে থেকে চিহ্নিত করতে হবে ডর্মিকে। বলাই বাহুল্য, তিনি ব্যর্থ হন এই পরীক্ষায়। এর পর আরও ঘণ্টা দুয়েক চলেছিল মামলা। কাঠগড়ায় বসে প্রশান্ত মনেই মামলার বাকিটা দেখেছিল ডর্মি। আর শাস্তি?
এজলাসের ১১ জন বিচারকের ১ জন মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি দিয়েছিল ডর্মিকে। তবে বাকিরা উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে নির্দোষ হিসাবেই বিবেচনা করে তাকে। ফলে, শেষ পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ড মকুব হয় তার। অন্যদিকে জরিমানা থেকে রেহাই পান ডর্মির মালিক ম্যাকমিলানও।
তবে এই মামলাই রীতিমতো বদলে দিয়েছিল সান ফ্রান্সিসকোর আইনকে। পোষ্যের লাইসেন্স, রাস্তায় পোষ্যকে নিয়ে বেরলে মুখবন্ধনী ব্যবহারের মতো বিষয়গুলিকে আবশ্যিক করে তোলা হয়। যদিও এসব করে কি কুকুর-বিড়ালের শত্রুতা দমানো যায়? যায়ওনি। চল্লিশের দশকেই আরও একটি ল্যাব্রাডরের বিরুদ্ধে বিড়াল হত্যার মামলা হয়েছিল মার্কিন আদালতে। তবে তৎপর হয়েই প্রশাসন বড়ো আকার নিতে দেয়নি সেটিকে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে, আইনের জগতে ডর্মিই শেষতম বিচার হওয়া পোষ্য তারকা। এমনকি আজও সান ফ্রান্সিসকোর আইনের কলেজগুলিতে রীতিমতো ফলাও করে পড়ানো হয় ডর্মির এই মামলাকে…
Powered by Froala Editor