মৃতদেহের দৌলতে বাঁচল অসংখ্য প্রাণ! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ঘটেছিল এমনই

কথায় আছে, ‘মরা হাতি লাখ টাকা’। আর মানবদেহ? আক্ষরিক অর্থে আদৌ কি তার মূল্য আছে কোনো? তবে এমন একটি অতিসাধারণ মৃতদেহই (Dead Body) বদলে দিয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (World War II) বহু সমীকরণ। বাঁচিয়েছিল হাজার হাজার মানুষের প্রাণ। সেই গল্পেই ফেরা যাক বরং। 

১৯৪৩ সালের ৩০ এপ্রিল। স্প্যানিশ উপকূলে ভেসে আসে এক ইংরেজ মেজরের মৃতদেহ। হাতে ব্রিফকেস। সারা গায়ে বিস্ফোরণের ক্ষতচিহ্ন। সর্বপ্রথম এক স্প্যানিশ মৎস্যজীবীর চোখে পড়ে বিষয়টি। তিনিই মৃতদেহটি উদ্ধার করে তুলে দেন স্প্যানিশ পুলিশের হাতে। প্রাথমিক তদন্তে জানা যায়, মৃত ব্যক্তির পরিচয় মেজর উইলিয়াম মার্টিন। আর তাঁর ব্রিফকেস থেকে মেলে বেশ কিছু গোপন নথি। আরও ভালো করে বলতে গেলে, গ্রিস এবং সার্ডিনিয়ার বেশ কিছু অঞ্চলে মিত্রপক্ষের আক্রমণ করার ছক। 

প্রশাসনিক তদন্ত শেষ হওয়ার পরেই, এই মৃতদেহ তুলে দেওয়া হয়েছিল স্পেনের ব্রিটিশ দূতাবাসের হাতে। তবে ব্রিফকেসের সমস্ত নথিই পৌঁছে যায় নাৎসিদের কাছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে স্পেন সরাসরি অংশ নেয়নি ঠিকই, তবে একাধিনায়ক হিটলারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ছিল স্প্যানিশ শাসকের। যাই হোক, ব্রিটিশ ইন্টেলের এই গোপন তথ্য হাতে পাওয়ার পরেই মিত্রপক্ষকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করে ফেলে নাৎসি বাহিনী। সিসিলি এবং দক্ষিণ ইউরোপ থেকে জার্মান সেনাদের অতিসন্তর্পনে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে মোতায়েন করা হয় গ্রিস এবং সার্ডিনিয়ায়। কিন্তু বিপক্ষের হাতে এত দামি তথ্য পৌঁছে গেছে, সে-কথা ঘুণাক্ষরেও টের পেল না ব্রিটেন?

আদতে এই গোটাটাই ছিল ব্রিটেনের পরিকল্পনা। সিসিলি থেকে জার্মানি সেনাবাহিনী সরিয়ে নিয়ে যাবে এটাই চেয়েছিল ব্রিটেন। আর সেই কারণেই মেজর উইলিয়াম মার্টিনের মৃতদেহ পাঠানো হয়েছিল স্পেনে। সঙ্গে কিছু ভুয়ো কাগজপত্র ও পরিচয়। হ্যাঁ, মেজর উইলিয়াম মার্টিন বলে উচ্চপদস্থ সামরিক আধিকারিকই ছিল না ব্রিটেনের। এই পরিচয় সম্পূর্ণ কৃত্রিমভাবে বানানো। কিন্তু তাঁর দেহ? সেটা তো মিথ্যে হতে পারে না! তবে? 

আরও পড়ুন
বোমা আটকাতে বাঁশের আচ্ছাদন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এভাবেই নিস্তার পেয়েছিল তাজমহল

শুরু থেকেই বলা যাক এই গল্প। তিরিশের দশকের শেষ দিক সেটা। বিশ্বযুদ্ধ সবে শুরু হয়েছে ইউরোপে। শত্রুপক্ষকে দিকভ্রান্ত করার জন্য এমনই এক ফাঁদ পেতেছিলেন জেমস বন্ড স্রষ্টা ইয়ন ফ্লেমিং। না, উপন্যাস লেখার খাতিরে নয়। ফ্লেমিং নিজেও ছিলেন ব্রিটিশ নৌবাহিনীর সামরিক আধিকারিক এবং ইন্টেলিজেন্স বিভাগের সদস্য। দেশের প্রতিরক্ষার জন্যই এই ছক সাজিয়েছিলেন ফ্লেমিং। তবে সে-সময় বাস্তবায়িত হয়নি এই পরিকল্পনা। 

আরও পড়ুন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষের ২৯ বছর পরেও যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছিলেন এই ব্যক্তি!

১৯৪৩ সালে ফ্লেমিং-এর এই সামরিক পরিকল্পনায় শিলমোহর চাপায় ব্রিটিশ সরকার। জার্মানি অধিকৃত সিসিলি দ্বীপ আয়ত্তে আনাই ছিল যার লক্ষ্য। চার্লস চাল্মন্ডেলে এবং এভিন মন্টেগু— এই দুই ব্রিটিশ গোয়েন্দাকে নিয়ে কাজ শুরু করেন ফ্লেমিং। ভুয়ো প্রশাসনিক কাগজপত্র এবং অন্যান্য নথি সবই তৈরি হয়ে গিয়েছিল প্রায়। শুধু সমস্যা বাঁধে মৃতদেহ খুঁজতে। সুঠাম-সুবল, দীর্ঘদেহী এক পুরুষের মৃতদেহ প্রয়োজন এই পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করতে। তা নাহলে বিপক্ষের চোখে ধুলো দিয়ে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করাটা যে বেশ শক্ত ব্যাপার। তবে মৃত সৈনিকদের দেহ ব্যবহার করার ক্ষেত্রে আসল তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার একটা ক্ষীণ সম্ভাবনা তো ছিলই। সেইসঙ্গে অধিকাংশ সামরিক আধিকারিকদের মৃতদেহ ইন্টেলিজেন্সের কাজে ব্যবহার করতে দিনে চায়নি তাঁদের পরিবার। ফলে বিকল্প পথের সন্ধান শুরু করেন ফ্লেমিং ও তাঁর দুই সহকর্মী। 

আরও পড়ুন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিনিদের গোপন হাতিয়ার ‘বাদুড় বোমা’

খানিক খোঁজাখুঁজির পর লন্ডন থেকে পাওয়া যায় এক তরুণ ওয়েলস যুবকের মৃতদেহ। নাম গ্লিন্ডর মাইকেল। সুদূর ওয়েলস থেকেই গ্লিন্ডর লন্ডনে এসেছিল চাকরির আশায়। কিন্তু কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের বাজারে কোথায় চাকরি? অনাহার আর অর্থকষ্ট যেন ক্রমশ টুঁটি চেপে ধরছিল তাঁর। এই জীবনযুদ্ধে হেরে শেষ পর্যন্ত ইঁদুর মারার বিষ খেয়ে আত্মহনন করেন গ্লিন্ডর। পরিবার-পরিজন, বাবা-মা কেউ-ই ছিল না গ্লিন্ডরের। ফলে, তাঁর দেহ-ই ইন্টেলিজেন্সের কাজে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেন ফ্লেমিং। নাম দেওয়া হয় মেজর উইলিয়াম মার্টিন। 

এতটাই নিপুণভাবে সাজানো হয়েছিল গোটা প্রেক্ষাপট যে স্পেন এবং জার্মানি— কোনো প্রশাসনের চোখেই ধরা পড়েনি বিষয়টি। সিসিলি থেকে অধিকাংশ সেনা এবং সামরিক সরঞ্জামই সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল নাৎসিরা। ফলস্বরূপ খোয়াতে হয় সিসিলির আধিপত্য। এই ঘটনার মাত্র সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই প্রায় দেড় লক্ষ সেনা নিয়ে সিসিলিতে আক্রমণ চালায় মিত্রপক্ষ। এই বিপুল পরিমাণ সেনার সামনে দাঁড়াতে পারেনি জার্মানদের অত্যাধুনিক প্রতিরক্ষ পরিকাঠামোও। দেড় মাসের মধ্যেই জয়। 

এই জয়ের নায়ক গ্লিন্ডর। গোটা পরিকল্পনা ছাড়া এই যুদ্ধ হলে প্রাণ যেত লক্ষাধিক মানুষের। যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হত কমপক্ষে আরও ৪ মাস। কেবলমাত্র একটি মৃতদেহই বদলে দেয় অতি-পরিচিত এই সমীকরণ। ব্রিটিশ ইন্টেলের খাতায় এই পরিকল্পনা লিপিবদ্ধ রয়েছে ‘অপরেশন মিন্সমিট’ নামে। আর গ্লিন্ডর? খুব বেশি মানুষ তাঁর কথা না জানলেও, মরণোত্তর নায়ক হিসাবে আজও বেঁচে রয়েছেন তিনি…

Powered by Froala Editor