একদিকে দিগন্ত বিস্তৃত সাহারা মরুভূমির ধূলিময় প্রান্তর। অন্যদিকে অন্ধকার অরণ্যের রহস্যময় জগত। কোথাও বা নীলনদের অববাহিকায় সুপ্রাচীন সভ্যতার ঐতিহ্য। অসংখ্য আদিম উপজাতি, হিংস্র পশুদের মাতৃস্নেহে পালন করেছে আফ্রিকা (Africa) মহাদেশ। যুগ যুগ ধরে সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণের কাছে পদানত থাকতে হয়েছে। বদলে গেছে ইতিহাস। বদলেছে ‘আফ্রিকা’-র আসল নামও। কীভাবে এল ‘আফ্রিকা’ শব্দটি? ইউরোপীয় উপনিবেশের আগে কী ছিল তার আসল নাম?
আফ্রিকা মহাদেশের ইতিহাসের বড়ো অংশ জুড়ে আছে লাঞ্ছনার ইতিবৃত্ত। শ্বেতাঙ্গ শাসকদের আদিম বর্বরতায় বহবার রক্তাক্ত হয়েছে তার কৃষ্ণাঙ্গ শরীর। দাসত্বের অন্ধকারাগারে নিক্ষিপ্ত হওয়া ছিল ভবিতব্য। খ্রিস্টজন্মের বহু পূর্বেই গ্রিক-রোমানরা আফ্রিকার উত্তরপ্রান্তে তৈরি করেছিল উপনিবেশ। অরণ্যেঘেরা দক্ষিণপ্রান্ত তুলনায় অজ্ঞাত ছিল বহুদিন। ক্রমে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের রথের চাকায় পরাজিত হল সম্পূর্ণ মহাদেশ। আবিষ্কৃত হল হিরের খনি। ইংল্যান্ড, পর্তুগাল, ফ্রান্স, ওলন্দাজদের লোলুপ হাতে ধ্বংস হল আফ্রিকার নিজস্ব ভূমি, নিজস্ব সংস্কৃতি।
শ্বেতাঙ্গরাই তার নাম রাখল ‘আফ্রিকা’। সপ্তদশ শতকে ইউরোপীয়দের যাতায়াত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রচলিত হতে থাকে এই নাম। তবে তখনও মূলত উত্তর অংশকেই ‘আফ্রিকা’ বলে চিহ্নিত করা হত। বহু আগে রোমানরা বর্তমান তিউনিসিয়ার কিছু অঞ্চল দখল করেছিল। সেখানকার আঞ্চলিক জনজাতি ‘আফ্রি’-র নাম থেকে উঠে এল আফ্রিকা। আবার রোমান শব্দ ‘আপ্রিকা’-র অর্থ রৌদ্র। আফ্রিকার নামকরণের পিছনে কাজ করতে পারে এই শব্দটিও। গ্রিক ভাষায় ‘আফ্রিকে’ শব্দের অর্থ ‘শীত আর ভয়’-এর দেশ। ইউরোপের বেশ কিছু অঞ্চলে ‘আফার’ শব্দের অর্থ ধুলো। সেখান থেকেও ‘আফ্রিকা’ মহাদেশের নাম জন্ম নেওয়ার তত্ত্বও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
কিন্তু এ তো গেল ইউরোপীয়দের দেওয়া নামের ইতিহাস। কিন্তু তার আগে? নিশ্চয়ই আফ্রিকার আদিবাসিন্দা মাতৃভূমিকে কোনো বিশেষ নামে ডাকতে শিখেছিল। সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে আসছে, ‘কেমেটিক’ ইতিহাস অনুযায়ী আফ্রিকা মহাদেশের পূর্বনাম ছিল আলকেবুলান (Alkebulan)। যার অর্থ স্বর্গোদ্যান বা মানবতার মাতা। এছাড়া আরও বেশ কয়েকটি নামে পরিচিত ছিল আফ্রিকা। কোরফাইয়ে, ওরতেগিয়া, লিবিয়া, ইথিওপিয়া ইত্যাদি।
আরও পড়ুন
স্বমহিমায় চলছে দাসপ্রথা, এখনও মধ্যযুগীয় অন্ধকারে ডুবে আফ্রিকার এই দেশ
ইউরোপীয়দের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত হয়ে যায় অতীত পরিচয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সাম্রাজ্য বিস্তারে তারা জোরপূর্বক চাপিয়ে দিয়েছে ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি। আফ্রিকায় সবথেকে কলঙ্কজনক সেই ইতিহাস। যার প্রাচীন ছিল ‘মানবতার মাতা’, তার শরীরকে হিংস্র হাতে ছিন্নভিন্ন করেছিল সাম্রাজ্যবাদীরা। ‘স্বর্গের উদ্যান’কে পরিণত করেছে নরকের ঘৃণ্য আস্তাকুঁড়ে।
আরও পড়ুন
একুশ শতকেও উপনিবেশ! আফ্রিকার শহর ঘিরে দ্বন্দ্ব স্পেন-মরক্কোর
আজও আফ্রিকার কিছু দেশ ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক নিয়মে বাঁধা। দীর্ঘ শোষণ-অপশাসন-জাতিদ্বন্দ্বে পিছিয়ে পড়েছে তার অগ্রগতি। দারিদ্র্য-অভাব নিত্যসঙ্গী। প্রাচীন নামের মতো আফ্রিকা কি ‘মানবতার মাতা’-র স্পর্শে সুস্থ হতে পারবে? হয়ে উঠতে পারবে ‘স্বর্গোদ্যান’?
Powered by Froala Editor