স্বাধীনতা কী, ভারত কী, ‘বিশেষ সুবিধা’ই বা কী— একটি রাষ্ট্র-আঁটুনি ফস্কা গেরোর গপ্প

India has never had a real sense of nationalism. Even though from childhood I had been taught that the idolatry of Nation is almost better than reverence for God and humanity, I believe I have outgrown that teaching, and it is my conviction that my countrymen will gain truly their India by fighting against that education which teaches them that a country is greater than the ideals of humanity.
(‘NATIONALISM IN INDIA’; Rabindranath Tagore)

স্বাধীনতা দিবস বলতে যে কী বোঝায়, সে কথা বুঝতে বুঝতেই অনেক বয়স পেরিয়ে যায়। আবার অনেক বয়স পেরিয়ে গিয়েও ঠিক বুঝে ওঠা যায় না। স্বাধীনতার বাংলা অর্থ আমরা ছোট থেকে বুঝে এসেছি ব্রিটিশ অধীনতা থেকে মুক্তি। বড় হয়ে শুনেছি, তা নাকি শুধুমাত্রই রাজনৈতিক ‘স্বাধীনতা’, ‘কলোনি’ত্ব থেকে মুক্তি! অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হওয়ার তাহলে অর্থ কী? এসব জটিল তত্ত্ব-চর্চার বিষয়। এক প্যাঁচ কাটাতে গেলে অন্য প্যাঁচ এসে জড়িয়ে ধরে। ব্রিটিশ ছাড়াতে গেলে আমেরিকা জড়িয়ে ধরে। সোভিয়েতের স্বপ্ন পেরেস্ত্রইকায় হোঁচট খায়। তিয়েন-আন-মেনের ট্যাংকের তলায় এশিয়ার মুক্তি-সূর্য ‘লাল-চিন’ চাপা পড়ে যায়। তৃতীয় বিশ্বের ‘আদতে নিঃস্ব’ বৃহত্তম গণতন্ত্রের কাছে ‘জাতীয়’-অস্তিত্বকে চিনে নেওয়ার জন্য পড়ে থাকে শুধু একটাই সিগনিফায়ার— কাশ্মীর!

যাক সেসব কথা। আমরা বরং ভারতীয় ইউনিয়নের স্বাধীনতার প্রসঙ্গে ফিরি। বিবিধ বৈচিত্রে সমৃদ্ধ ভারতবর্ষকে যে ইওরোপীয় নেশন-স্টেট ধারণার ‘একক’ খোপে পুরে ফেলা যায় না—সে কথা তো হাড়ে-হাড়েই মালুম হচ্ছে। মুশকিল হল, ব্রিটিশ কলোনি থেকে ‘স্বাধীন কলোনি’তে রূপান্তর প্রক্রিয়ার চিন্তা-নায়করাও সে-কথা বুঝেছিলেন। কিন্তু, ইওরোপীয় নেশন-স্টেট ধারণার থেকে ‘উন্নত’ কিছুর অবকাশ তখন ছিল না। ভারতীয় সমাজের স্বাভাবিক গণ্ডির ওপর দিয়ে নানা ধরনের ভাষা-প্রদেশভিত্তিক রাজ্য-বিভাজন করে এই বিবিধতার গণ্ডিকে বেঁধে দেওয়ার চেষ্টা হল। বিভিন্ন রাজ্য ভারতীয় ইউনিয়নে যুক্ত হয়ে রাষ্ট্রের অবয়ব তৈরি করবে—এই ছিল ভাবনা।

মূল ভারতীয় অংশ, যেটি ব্রিটিশ শাসনাধীনে থাকা অবস্থা থেকে ১৯৪৭-এর ১৫ আগস্ট স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে, তার সঙ্গে এরপর বিভিন্ন স্বাধীন রাজ্য জুড়তে জুড়তে গেছে।

এরকম যুক্তরাষ্ট্রীয় ভাবনাতেও গোলমাল আছে। ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের বিষয়টা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মতো একেবারেই নয়। তাই, ‘আম্রিগা তো বেশ আছে’-- গোছের তর্ক এখানে চলবে না। গোলটা হল, রাষ্ট্রীয় পরিচিতি তাহলে কী হবে? পশ্চিমবঙ্গ থাকলে বাঙালি, বিহারে থাকলে বিহারী, তামিলনাড়ুতে থাকলে তামিল—এসব হল ভাষাভিত্তিক পরিচিতি। আরেকটু বাড়িয়ে নিয়ে ভাবা যেতে পারে ভাষা-সংস্কৃতিভিত্তিক পরিচিতি বাস্তবে একটা মানে আছে, সামাজিক জীবনে-যাপনে অস্তিত্ব আছে। কিন্তু, এইসব ভারতীয় ইউনিয়নে মিলে যে ভারতরাষ্ট্রের অবয়ব তৈরি করল, সেখানে নাগরিকের পরিচয় কী? ভারতীয়? তাহলে ভারতীয় বড় না বাঙালি বড়, বিহারী বড়, তামিল বড়? কোনটা প্রধান পরিচিতি? রাষ্ট্রবাদীরা বলবেন, ভারতীয়ই তোমার প্রধান পরিচিতি। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়াবে, যেভাবে বাংলার ভাষা-সাংস্কৃতিক যাপনের বাস্তব অস্তিত্ব আছে, তামিলের ভাষা-সাংস্কৃতিক যাপনের বাস্তব অস্তিত্ব আছে, বহু যুগ ধরেই আছে—ভারতীয়ত্বের বাস্তব অস্তিত্বের প্রকৃত অর্থ কী? ‘ভারতীয়’ কারে কয়?

ইউরোপীয় নেশন-স্টেটে এর একটা উত্তর আছে। ফরাসি তারাই যারা ফ্রান্স নামক ভূ-খণ্ডে বসবাস করেন এবং ফরাসি জাতির মানুষ। এই ফরাসি জাতিসত্তা ফরাসি ভাষা-সংস্কৃতিজাত শুধুমাত্র নয়, তা বিবিধ পরিচিতিসত্তা ও বিবিধ সংস্কৃতি-যাপনের সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে—সেটাও আসলে নয়। ফ্রান্স ভূখণ্ড বলে যা পরিচিত, সেখানে অনেক ভাষাগোষ্ঠী ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষই ছিলেন। ফ্রান্স জাতি-রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশ্যে সেই সমস্ত ভাষাকে ধ্বংস করে, বিবিধ সংস্কৃতির মূলোচ্ছেদ করে ফরাসি ভাষাকেন্দ্রিক একটি কেন্দ্রীয় সংস্কৃতিকে জন্ম দিতে হয়েছে।

আজ ভারতরাষ্ট্রে যতগুলি ভিন্ন-ভিন্ন সংস্কৃতি-ভাষা-গোষ্ঠী-জাতি বর্তমান তাদের একত্রে কোনো ‘কেন্দ্রীয় ইতিহাস’ও সেভাবে নেই।

মুশকিল হল, ‘ভারতীয়’ বলে কোনও কেন্দ্রীয় ‘সংস্কৃতি’ নেই, কোনও কেন্দ্রীয় ভাষাও নেই। এমনকি, আজ ভারতরাষ্ট্রে যতগুলি ভিন্ন-ভিন্ন সংস্কৃতি-ভাষা-গোষ্ঠী-জাতি বর্তমান তাদের একত্রে কোনো ‘কেন্দ্রীয় ইতিহাস’ও সেভাবে নেই। ভারতীয় ভূ-খণ্ডের যে দীর্ঘ সামাজিক ইতিহাসের টানাপোড়েন তা আদতে ‘এক-জাতি’ তত্ত্বকে খারিজ করে। ‘জাতি’ দিয়ে মাপতে চাওয়ার রাজনীতিকেই খারিজ করে। যাক, সে অন্য আলোচনার বিষয়।

স্বাধীন ভারতরাষ্ট্রের রাষ্ট্রনায়কেরা ‘ভারতীয়ত্ব’-এর জাতীয়তাবাদী বা উগ্রজাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে যতটা না ভারতীয় ভূ-খণ্ডের ঐতিহাসিক বিবর্তনের ইতিবাচকতায় নির্মাণ করতে পেরেছেন, তার চেয়ে বহুগুণ বেশি পেরেছেন পাকিস্তানকে গুঁড়িয়ে দিতে চেয়ে বা কাশ্মীরকে মূল-ভারতীয় ভূ-খণ্ডের অংশ করে তোলার যুদ্ধনীতি দিয়ে। ৩৭০ ও ৩৫-এ ধারা প্রকারান্তরে খারিজ ক’রে কাশ্মীরের ‘বিশেষ’ তকমা উঠিয়ে দেওয়ার পর থেকে দেশ জুড়ে কেন্দ্রীয় শাসক দল এবং তার মিডিয়া-প্রপাগান্ডিস্টরা যেভাবে ‘ভারতীয়ত্ব’ নির্মাণ করছে, সেদিকে তাকালেই বিষয়টা মালুম হবে। যারা এই পদক্ষেপের বিরোধিতা বা সমালোচনা করছেন তাদেরকে ভারত-বিরোধী বলা হচ্ছে। পাকিস্তান আর তারা একই ব্র্যাকেটে।

সেই একই কায়দা। একটি ‘শত্রু’ বানিয়ে তার নিরিখে নিজের অস্তিত্ব নির্মাণ। এই ধরণের নির্মাণের প্রাকশর্ত হল, স্বাভাবিক যুক্তি-বুদ্ধি-বিচারকে মুহূর্মুহু প্রচারের অভিঘাতে স্তব্ধ করে দেওয়া। তাই, যতই কথা উঠুক না কেন, ৩৭০-এর মত অনেক ধারা আরও বিভিন্ন রাজ্যে প্রচলিত, সেখানেও বাইরের লোক জমি কিনতে পারে না, কে সে দিকে কান দিচ্ছে। ‘কাশ্মীর’-কে জব্দ করে যে ‘ভারতীয়ত্ব’-এর ইগো স্যাটিসফায়েড হয়, সেটা অন্য জায়গায় করতে গেলে এই উগ্র-জাতীয়তাবাদী ‘ভারতীয়ত্ব’ই না ঝুরঝুর ক’রে ভেঙে পড়ে!

ঠিক যেভাবে কাশ্মীর ৩৭০ ধারার সুবিধা পেত, নাগাল্যান্ডও ৩৭১-এ ধারার সুবিধা পায়। এটা তার জমির অধিকার সুনিশ্চিত করে নাগা-জনজাতির প্রথাগত আইনমাফিক।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় রাষ্ট্রীয় পরিচিতিতে যে গোলমাল থাকবে—এ কথা স্বাধীন ভারত রাষ্ট্রের নায়কেরাও বুঝতেন। ব্রিটিশরা তো একথা পুরো শাসনকাল জুড়েই বুঝে এসেছেন। দেশভাগ থেকে রাষ্ট্র-গঠনের সময়ের যাবতীয় দড়ি-টানাটানিও সে-কারণেই। স্বাধীন ভারতরাষ্ট্রে বাঙালি যেভাবে নিজেকে ভারতীয় বলে মেনে নিতে পারবেন, একই ভাবে কি পারবেন অসমিয়ারা? তাদের অসমিয়া জাতি গঠনের ইতিহাসটাই তো অনেকটা আলাদা বাঙালিদের থেকে। আদিবাসীরা, যারা গোটা ব্রিটিশ শাসন জুড়ে ব্রাত্য, বিচ্ছিন্ন স্বদেশী আন্দোলন থেকেও—তারা কীভাবে এক সুন্দর সকালে ‘ভারত ভাগ্যবিধাতা’ গাইতে গাইতে রাষ্ট্রবন্দনা করবেন! গোটা উত্তর-পূর্ব ভারত, ভারতের ‘জাতীয় সঙ্গীত’-এও যাদের জায়গা হয়নি—তারা কোন আদর্শের বলে একদিন ঘুম থেকে উঠেই ভারতীয় হয়ে উঠবেন?

শুধু তো এটুকুই নয়। মূল ভারতীয় অংশ, যেটি ব্রিটিশ শাসনাধীনে থাকা অবস্থা থেকে ১৯৪৭-এর ১৫ আগস্ট স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে, তার সঙ্গে এরপর বিভিন্ন স্বাধীন রাজ্য জুড়তে জুড়তে গেছে। সিকিমের ভারতীয় ইউনিয়নভুক্তি হয়েছে ১৯৭৫ সালে। ছিটমহল সমস্যা নিয়ে পাকাপাকি চুক্তি হল এই ক’দিন আগে। যে পরে এল বা যে রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়ায় প্রথম থেকে দূরে দূরেই ছিল, তাদের সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের রাজনৈতিক মানচিত্রের পার্থক্য তো থাকবেই। সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য তো রাষ্ট্র দিয়ে মেটানো সম্ভব নয়। কিন্তু রাষ্ট্র-গঠনের মধ্যেই যে বৈষম্য জন্মসূত্রেই প্রাপ্ত, তাকে মেটানো হবে কী করে! ভারতে সংবিধানের ক্ষেত্রবিশেষে বিশেষ সুবিধাগুলি সে জন্যেই দেওয়া।

ভারতীয় বড় না বাঙালি বড়, বিহারী বড়, তামিল বড়? কোনটা প্রধান পরিচিতি?

ঠিক যেভাবে কাশ্মীর ৩৭০ ধারার সুবিধা পেত, নাগাল্যান্ডও ৩৭১-এ ধারার সুবিধা পায়। এটা তার জমির অধিকার সুনিশ্চিত করে নাগা-জনজাতির প্রথাগত আইনমাফিক। ৩৭১-বি এর সুবিধে পায় অসম। মনিপুর, অরুণাচল সহ উত্তর-পূর্বের সমস্ত রাজ্য এই সুবিধে পায়—তার মূল কারণ তারা মূল ভূখণ্ড থেকে গোটা রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়াতেই বিচ্ছিন্ন, রাষ্ট্রীয় পরিসরে তাদের ক্ষমতা সীমিত। হঠাৎ করে দিল্লি আর ইম্ফলকে দাঁড়িপাল্লায় মাপলে তো চলবে না! শুধু উত্তর-পূর্ব কেন, ৩৭১ ধারা মোতাবেক ‘সুবিধে’ পায় মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, গোয়া, অন্ধ্রপ্রদেশও।

কেউ মহান ছিল বলে এই সুবিধেগুলি দিয়েছিল এমন নয়। এগুলি বহু-ভাষিক, বহু-সংস্কৃতির, বহু-যাপন-বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এক ভূখণ্ডকে ইওরোপীয় ধাঁচে ‘রাষ্ট্র’ ক’রে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় চেক-অ্যান্ড-ব্যালেন্স। এতদিনে ভারতরাষ্ট্রের যদি কোনও ‘স্ব’ প্রকৃত অর্থেই তৈরি হয়ে থাকে, তবে এগুলি তুলে নিলেও নিশ্চয়ই সেই ‘স্ব’-এর অধীনেই দিব্যি এগোতে পারবে! আর অন্যথায়? ঠিক এই ক’দিনের কাশ্মীরের মতো।

মতামত লেখকের ব্যক্তিগত

More From Author See More