কোভিড-পরবর্তী কর্মক্ষেত্রে, কী ভাবছেন কর্পোরেটের মহিলা নেতৃত্বরা?

কাজের জায়গায় মহিলারা আজও লিঙ্গভিত্তিক ইস্যুর জাঁতাকলে আটকে পড়েন। দেশ বা রাজ্যের প্রধান হলেও পরিস্থিতি পাল্টায় না। এমনকি কর্পোরেট বোর্ডরুমেও মনে করা হয় পুরুষ সহকর্মীটির মতোই দ্রুত ও কঠোর সিদ্ধান্ত নেবেন মহিলারা। আবার যেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তখন অন্যকিছু বলা হয়। আবার ওই মহিলারাই যখন শান্ত হয়ে, সহানুভূতির সঙ্গে কোনো সিদ্ধান্ত নেন, তখন তা নিয়েও আপত্তি থাকে অনেকের। কিন্তু এখন পরিস্থিতি অন্য। পৃথিবী জুড়ে করোনা অতিমারী এক অন্যরকম জায়গা তৈরি করেছে। আগে যা যা নিয়ম মানা হত, সমস্তকিছু ভেঙে নতুন করে কিছু তৈরি করার সময় এসেছে। আর এখানে অবধারিতভাবে সামনে এসেছে নারীশক্তির কথা। বিশেষ করে, জার্মানি, নিউজিল্যান্ড, তাইওয়ান যেভাবে এই পুরো পরিস্থিতি সামলেছে, তা দেখে এই নারীশক্তির জয়গানই দেখছে বিশ্ব। 

কর্পোরেট পরিবেশ, কাজের জায়গা ও অন্যান্য নানা ক্ষেত্রে এই লিঙ্গভিত্তিক ইস্যু নিয়ে অনেক রিপোর্ট তৈরি হয়েছে। ধরা যাক, ফোর্বসের ১৯ এপ্রিল ২০২০-র ইস্যু ‘কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে এসে মহিলারা কেন এত ভালো নেতৃত্ব দিচ্ছেন’; ১৫ মে’র নিউ ইয়র্ক টাইমসে ‘অতিমারীর সময় মহিলা রাষ্ট্রনেতাদের জয়জয়কার কেন’; ১২ মে’র স্ট্যানফোর্ড মেডিসিনে ‘করোনা অতিমারীতে ক্রমশ উজ্জ্বল হচ্ছেন মহিলা নেতৃত্বরা’… এবং, আরও অনেক। ২০২০-র ৩ এপ্রিলে থমাস রয়টার্স ফাউন্ডেশন ট্রাস্ট ও ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের একটি রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বজুড়ে যতজন স্বাস্থ্যকর্মী আছেন, তাঁদের ৭০%ই মহিলা। এবং এটাই প্রশ্ন তুলছে যে ‘এই মুহূর্তে কেন মহিলা নেতৃত্বই দরকার’। 

১২ মে, ২০২০-তে দ্য ইউরোনিউজের পক্ষ থেকে একটি খবর প্রকাশ করা হয়েছিল। সেখানে বলা হচ্ছে, ‘করোনা ভাইরাসের এই পরিস্থিতিই আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে কেন মেয়েদের আরও এগিয়ে আসা উচিত।’ রাজনীতির ময়দান হোক বা কর্পোরেট দুনিয়া, সমস্ত জায়গায় মেয়েদের ভূমিকা নিয়েই বিস্তৃত আলোচনা করা হয়েছিল এই খবরে। আর এই আলোচনা করতে করতেই পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে, যা বেশিরভাগ মহিলা নেতৃত্বের মধ্যে দেখা যায়। স্বচ্ছতা বা সততা, দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ, উল্টোদিকের মানুষটির অবস্থা বোঝা এবং সেই অনুযায়ী সঠিক ব্যবস্থা নেওয়া, কথাবার্তায় দক্ষতা এবং সহানুভূতি-সংহতি প্রদর্শন। এবার এই পুরো বিষয়টিকে ভারতের নিরিখে দেখা যাক। এবার সেটা কেমন হয়, কেমন দৃষ্টিভঙ্গি সেটা জানারই প্রয়োজন। 

নুভাহ এলিন্ট এলএলপি এবং বিয়াসিঙ্কের পজিটিভ সাইকোলজি-ভিত্তিক গবেষণায় ভারতের সমস্ত জায়গা, সমস্ত পরিবেশ থেকে আসা মহিলা নেতৃত্বদের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। তাঁরা প্রত্যেকেই এই ব্যাপারগুলো খুব গুরুত্ব দিয়ে ভাবছেন। এবং তাঁরা এও বলছেন, কেন এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আচরণ ও দক্ষতার বিষয়গুলির দিকে নজর দেওয়া উচিত। 

আরও পড়ুন
ভারতের কর্পোরেট-ক্ষেত্রে বাড়ানো উচিৎ সহনশীলতা, কিন্তু কেন?

নিয়োগকর্তা-চাকুরীজীবীদের প্রত্যাশা

আরও পড়ুন
ভারতে অতিমারী-পরবর্তী কর্পোরেট চিত্র : বদল আনতে হবে নেতৃত্বের প্রশিক্ষণেও

এই ব্যাপারে সংস্থার অংশীদারদের ডাকা হয়েছিল এবং তাঁদের কাছ থেকে জানার চেষ্টা করা হয়েছিল যে বসের থেকে একজন কর্মীর প্রত্যাশাগুলি কী? এবং এর উল্টোটাও জানতে চাওয়া হয়েছিল।

আরও পড়ুন
লকডাউনের মধ্যেই দেশের বনাঞ্চলের ওপর কর্পোরেট থাবা, মদতে প্রশাসনও

অ্যাক্সিস সিকিউরিটির প্রধান এইচআর সোনু ওয়াদেওয়ালার মতে, “সবার প্রথমে যেটা দরকার সেটা হল স্বচ্ছ এবং স্পষ্ট একটা বার্তা দেওয়া। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আমরা প্রায় প্রত্যেকেই অনেক সমস্যার মুখে পড়ছি। অনেক চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে। সেসব নিয়ে ঠিকঠাক কথা বলা, নিয়মিত ইনপুট দেওয়া, এবং সাফল্য-ব্যর্থতা দুটো ক্ষেত্রেই পাশে দাঁড়ানো— এটাই গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয়ত, এমন নেতৃত্ব যারা সহানুভূতিশীল। একটা সময় এই বিষয়টার দিকে সেভাবে নজরই দেওয়া হয়নি; কিন্তু এখন এটা খুবই প্রয়োজনীয়। একটা সংস্থা বা টিমের মানসিক পরিস্থিতি বোঝা, তাঁদের সঙ্গে থাকা, সাহস দেওয়া, পাশে থাকা— এটাই তো দরকার। এবং তৃতীয়ত, আজকের এই ডিজিটাল যুগে দাঁড়িয়ে যেটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জিনিস— দ্রুততা। প্রযুক্তিগত উন্নতি করা, ভার্চুয়াল মিটিং, কাজের জায়গায় নতুন করে স্কিল তৈরি করা, এবং এই সবটাই করতে হবে খুব তাড়াতাড়ি। বদলে যাওয়া পরিস্থিতির সঙ্গে দ্রুত মানিয়ে নিতে হবে।”

স্বরনিম ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ডিরেক্টর স্বাতী সারাওগিও ঠিক এই জায়গা থেকেই বিষয়টি দেখছেন। “আজ সবাই নিজের নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে লড়ে যাচ্ছে, চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে— এটা সবার আগে আমাদের বোঝা দরকার। যেমন, এই মুহূর্তে দেশের যা অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, তাতে অনেক অভিভাবকই হয়তো বাচ্চাদের স্কুলের মাইনে দিতে পারছেন না। সেখানে আমাদের তো তাঁদের প্রতি সহানুভূতিই দেখাতে হবে, তাঁদেরকে বুঝতে হবে। সেইসঙ্গে অন্যরকম রাস্তাও বের করতে পারি। আমাদের স্কুলে যেমন আমরা প্রত্যেকে একদিনের বেতন দান করেছি। সেই টাকা জমিয়ে গরিব বাচ্চাদের খাবারের ব্যবস্থা করেছি। এরকম ব্যবস্থা, এরকম কাজই ভবিষ্যতকে তৈরি করবে।”

ন্যাশনাল এমএসএমই কমিটি, ফিকির প্রাক্তন চেয়ারপার্সন এবং টাচস্টোন জেমস অ্যান্ড জুয়েলারির ডিরেক্টর অর্চনা গাড়োডিয়া গুপ্তার মতে, সংস্থার কর্তা ও কর্মীদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসই প্রধান। “যদি ভালো একটি টিম তৈরি করতে হয়, তাহলে একে অন্যের ওপর ভরসা রাখাটা খুবই দরকার। এতে করে দুপক্ষই সম্পর্কের মূল্য বুঝবে। লকডাউনের সময় আমাদের অফিস থেকে কাউকেই চাকরি ছেড়ে চলে যেতে হয়নি। কারণ বিপদের দিনে আমরা তাঁদের পাশে ছিলাম, তাঁদের কষ্ট বুঝেছিলাম। অনেকেই বাড়ি থেকে কাজ করেছেন।”

হারপারকলিনস পাবলিশার্স ইন্ডিয়ার এইচআর ডিরেক্টর পালক ভাটসও এমন কথাই বলছেন। “এই মুহূর্তে অনেকেই বাড়ি থেকে কাজ করছেন। তাই টিম লিডারদের সঙ্গে অনেকেরই মুখোমুখি কথা হচ্ছে না, কাজ দেখা যাচ্ছে না। এই পরিবেশে কাজ করতে গেলে একে অপরের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে এবং মুক্তমনা হতে হবে। হতেই পারে যে, আজকের কাজের পরিবেশে দাঁড়িয়ে সেই ভরসার জায়গাটা কোথাও গিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে টিমের প্রত্যেকের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলে যাওয়াটা জরুরি। এতে কাজে স্বচ্ছতাও আসে, তাঁরাও ভরসার জায়গাটা ফিরে পান।”

ভবিষ্যতের জন্য যে সব দক্ষতা প্রয়োজন 

অংশীদারদের বলা হয়েছিল, কোভিড পরবর্তী পরিস্থিতিতে কাজের জায়গায় এমন কোন কোন দক্ষতা দেখতে চান, যা আপনাদের মতে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। মোট ২৪টি সেটের মধ্যে অধ্যবসায়, টিমওয়ার্ক, নিজস্বতা, নেতৃত্ব প্রদানের ক্ষমতা, সাহস এই বিষয়গুলিই প্রথম সারিতে রয়েছে। অন্তত ৩০% নিজের তালিকায় সবার ওপরে রেখেছেন অধ্যবসায়কে। 

অর্চনা গাড়োডিয়া গুপ্তা বলছেন, “আজকে যেখানে চারিদিকে এত অনিশ্চয়তা, সেখানে দাঁড়িয়ে আমার মতে অধ্যবসায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটা পর্যায়ের পর আর না পেরে অনেকেই হাল ছেড়ে দিতে চান। সেখানে অধ্যবসায় নিয়ে লেগে থাকলে একটা পর্যায়ের পর মন থেকে নেগেটিভিটি চলে যায়। যতক্ষণ পারব চেষ্টা করে যাব— এটাই এখন দৃষ্টিভঙ্গি হওয়া উচিত।”

সমস্ত গুণের মধ্যে ভালোবাসা, প্যাশন আর সহানুভূতি প্রদর্শনই আসল বলে মনে করছেন পালক ভাটস। “যদি কর্মীদের প্রতি সহানুভূতিপ্রবণ না হওয়া যায়, তাঁদের প্রতি ভালোবাসা না থাকে, তাহলে সেই নেতৃত্ব অচিরেই মুখ থুবড়ে পড়বে। মানবিক অনুভূতিগুলো যদি কাজের জায়গায় জুড়ে যায়, তাহলে বিশ্বাসও আপনাআপনিই তৈরি হবে।”

দামোদর রোপওয়ে অ্যান্ড ইনফ্রা লিমিটেডের ডিরেক্টর এবং ফিকির কলকাতা শাখার মহিলা টিমের চেয়ারপার্সন সুনিরা চামারিয়ার মতে টিমওয়ার্ক এবং সাহস এখন গুরুত্বপূর্ণ দিক। “এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে সমস্ত জায়গায় বাজারের পরিস্থিতি খুবই খারাপ। কাজের জায়গায় বিপুল বদল আনা দরকার; তা না হলে ভবিষ্যতে টিকে থাকা মুশকিল হবে। এবং টিমের নেতৃত্বকেও নিজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। এবং এখানেই টিমওয়ার্ক গুরুত্বপূর্ণ। শুধু কাজের জায়গাতেই নয়, টিমের সঙ্গে যদি সবদিক থেকেই সম্পর্ক ভালো থাকে, তাহলে কাজের পরিবেশও বদলে যায়। কাজটিও ভালোভাবে করা যায়।”

শিক্ষাবিদ, সামাজিক কর্মী এবং সার্কের পুরস্কারজয়ী সায়রা শাহ হালিমেরও মতে, সহানুভূতি এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। “আমাদের ভারতে সমস্যা হল, কাজের জায়গায় কখনই মানবিক বুদ্ধিমত্তা বা ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে ভাবা হয় না। এছাড়াও বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ কাজ করতে আসেন। সেই জায়গাটা নিয়েও কম ভাবা হয়। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে ‘আমাদের’ কথা ভাবা দরকার, ‘আমার’ বা ‘তোমার’ কথা নয়।”

দ্য ক্রিয়েটিভ আর্টসের ডিরেক্টর এবং জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেত্রী-পরিচালক রামনজিত কৌরও একই কথা বললেন। “আমরা যদি একে অপরের ওপর দয়াপ্রবণ না হই, তাহলে গোটা সিস্টেমটাই ভেঙে পড়বে। এটা ভাবা দরকার যে আমরা যারা কাজ করছি একসঙ্গে, তাঁরা মানুষ; কোনো যন্ত্র নই। আমাদেরও আবেগ, জীবন রয়েছে। সেই বিষয়গুলিকেও অফিসের পরিবেশের মধ্যে রাখা উচিত। আর এসব থাকলে কাজেরও তো উন্নতি হয়।”

দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ

এখানে ওই অংশীদারদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ভবিষ্যতে ভালো জায়গা যেতে হলে, কাজের পরিবেশে ঠিক কীরকম দৃষ্টিভঙ্গি হওয়া উচিত। তিনটে দিকের কথা বলা হয়েছিল— আত্মবিশ্বাস, সহনশীলতা এবং চরিত্রের দৃঢ়তা। বলা হয়েছিল ১০-এর মধ্যে কত দিতে চান আপনারা। অদ্ভুতভাবে, এই তিনটে বিষয়কেই যথেষ্ট ভালো নম্বর দিয়ে উৎরে দিয়েছেন তাঁরা। যেখানে আত্মবিশ্বাসের দিকে নম্বর ৮.৪৬; এবং অন্য দুটি বিষয়ের জন্য ৮.৭৭। 

রামনজিত কৌরের মতে, “তিনটে বিষয়ই পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত। তবে সবথেকে বেশি জরুরি হল দৃঢ়তা। জীবন ক্রমশ কঠিন থেকে কঠিনতর দিকে যাচ্ছে, ততই এই বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।” সায়রা শাহ হালিম এর সঙ্গে জুড়লেন অন্য একটি জিনিস। “আমার মনে হয়, এইসবের সঙ্গে আত্মবিশ্বাসও গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি এবং আত্মবিশ্বাস ঠিক থাকলে, কাজের জায়গায় আরও ভালো জায়গায় যাওয়া যাবে। আত্মবিশ্বাস কম থাকলে চারিত্রিক দৃঢ়তা ও সহনশীলতা কোনোটাই তৈরি হবে না।”

Powered by Froala Editor

Latest News See More