ঝাঁ-চকচকে ঘরের মধ্যে স্যুট-বুট পরে বসে আছেন দুই ভদ্রলোক। হাতে ধরা খবরের কাগজ। আর কাচের জানলার ওপর বড়ো বড়ো হরফে লেখা ‘এলিট স্পেস ক্লাব’। অন্যদিকে দরজার কড়া নাড়ছেন এক ভারতীয় ব্যক্তি। পরনে হাঁটু পর্যন্ত গোটানো ধুতি, সাদামাটা জামা। সঙ্গে আস্ত একটি গরু।
২০১৪ সালের অক্টোবর মাস। মঙ্গলে পৌঁছেছে ভারত। তাও আবার প্রথম প্রচেষ্টাতেই। আরও আশ্চর্যের বিষয় হল, এই গোটা অভিযানের খরচ নাকি ভারতীয় মুদ্রায় মাত্র ৪৫০ কোটি টাকা। তাবড় হলিউডি মুভির বাজেটের থেকেও যা কম। একদিকে যখন মঙ্গলজয়ের এই উন্মাদনায় ফুটছিল গোটা দেশ, সে-সময়ই মার্কিন সংবাদপত্র নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত হয়েছিল এই ব্যতিক্রমী ব্যাঙ্গচিত্র। শুধুই কি মার্কিন সংবাদমাধ্যম? দেখতে গেলে ভারতের এই সাফল্যকে খুব একটা ভালো চোখে দেখেনি পাশ্চাত্য। অথচ, এক দশকের মধ্যেই সম্পূর্ণভাবে বদলে গেছে এই ছবি। ইসরোর চন্দ্রযান নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহের অভাব নেই পশ্চিমী দুনিয়ার। এমনকি ডিপস্পেস অ্যান্টেনার মাধ্যমে চন্দ্রযানের ল্যান্ডার মডিউলের স্বাস্থ্য, অবস্থান এবং গতিবিধির নজরদারি নিচ্ছে নাসা, ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি ও অস্ট্রেলিয়া। প্রয়োজনীয় তথ্য তুলে দিচ্ছে ইসরোর হাতে। প্রশ্ন থেকে যায়, এই আকস্মিক রদবদলের কারণ কী? কেনই-বা চন্দ্রযান ৩-এর সাফল্যের দিকে চেয়ে রয়েছে গোটা বিশ্ব?
এই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে ইতিহাসের দিকে তাকানোও প্রয়োজন বইকি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সোভিয়েত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে শুরু হয়েছিল দ্বৈরথ— ঠান্ডা যুদ্ধ। পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার গড়ে তোলার পাশাপাশি মহাকাশও হয়ে ঠান্ডা যুদ্ধের অন্যতম ময়দান। বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের থেকেও সেখানে মুখ্য হয়ে উঠেছিল জাতীয়তাবাদ, মতাদর্শের ফারাক, বিশ্ব রাজনীতির সমীকরণ এবং সামরিক স্বার্থ। ফলে দুই পক্ষই ভুরি ভুরি অর্থ বিনিয়োগ করেছিল মহাকাশ গবেষণায়। সে-যুদ্ধে চাঁদের বুকে মানুষ পাঠিয়েই শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র জয়ের স্বাদ পেলেও, নাসার সাফল্য কিন্তু নজরকাড়া ছিল না মোটেই।
কথাটা শুনে একটু আশ্চর্য লাগতে পারে। এখনও পর্যন্ত বিশ্বের একমাত্র যে-দেশের মানুষ চাঁদে পা রেখেছে, তাদের সাফল্যকে খাটো করা চলে কীভাবে? তবে পরিসংখ্যান দেখলেই বোঝা যাবে আসল বিষয়টা। ১৯৫৮ সালের পর থেকেই চন্দ্রাভিযানের লড়াই শুরু হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েতের মধ্যে। এই সময় থেকে শুরু করে ১৯৭০ সালের মধ্যে এই দুই দেশ সবমিলিয়ে ৮০ বার প্রচেষ্টা করেছে চাঁদে পৌঁছানোর জন্য। যার মধ্যে সাফল্য এসেছিল মাত্র ৩৪টিতে। অর্থাৎ, সাফল্যের হার মাত্র ৪২ শতাংশ। সোভিয়েতের ক্ষেত্রে এই হার ছিল আরও খানিকটা কম। আরও সঠিকভাবে বলতে গেলে ৩৯ শতাংশ। যা আশাপ্রদ নয় মোটেও।
আরও পড়ুন
মহাকাশে প্রথমবার মানুষ পাঠাতে চলেছে ইসরো
আরও পড়ুন
মহাকাশে পাঠানো হবে ব্যোম মিত্র-কে, ঘোষণা ইসরোর
তবে মজার বিষয় হল, ১৯৭২ সালে শেষবার চাঁদে মানুষ পাঠিয়েছিল নাসা। তারপর থেকে প্রায় ৫০ বছর কেটে গেলেও, আর এই ধরনের অভিযানের চেষ্টা করেনি যুক্তরাষ্ট্র। মহাকাশজয়ের যুদ্ধ থেকে সরে এসেছিল সোভিয়েতও। তার কারণ সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই উত্তাপ কমতে থাকে ঠান্ডা যুদ্ধের। ফলে, মহাকাশ অভিযানে বাড়তি অর্থ খরচ না-করার সিদ্ধান্ত নেয় এই দুই মহাশক্তি। এমনকি সত্তরের দশকের পর যে-সকল মহাকাশ অভিযান হয়েছে বিশ্বযুদ্ধে, সেখানে বৈশ্বিক রাজনীতির থেকে কোথাও গিয়ে সামান্য হলেও বেশি প্রাধান্য পেয়েছিল বিজ্ঞান।
এই রীতিতে আবার ছেদ পড়ে চলতি শতাব্দীর প্রথম দশকে। বলতে গেলে প্রথম দশকের শেষ থেকেই শুরু হয় ভিন্ন এক অঘোষিত ঠান্ডা যুদ্ধ। এই সমীকরণের একদিকে যুক্তরাষ্ট্র, অন্যদিকে রয়েছে চিন। রাজনৈতিক মতবিভেদ তো রয়েছেই, তাছাড়াও চিনের আগ্রাসী মনোভাব, ক্রমশ বাড়তে থাকা অর্থনীতিই যুক্তরাষ্ট্রকে সামিল করেছিল এই ঠান্ডা যুদ্ধে। বাণিজ্য ক্ষেত্র ছাড়িয়ে সেই দ্বন্দ্ব কি ছড়িয়ে পড়েনি মহাকাশেও? চাঁদ তো বটেই, মঙ্গলের উপগ্রহ ফোবসেও মহাকাশযান পাঠিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে চমক দেওয়ার যৌথ প্রচেষ্টা চালায় চিন ও রাশিয়া। যদিও সেই মহাকাশযান বিস্ফোরিত হয়েছিল মাঝ-আকাশেই। এসবের মাঝেই উত্থান ইসরোর। প্রথমত সাশ্রয়ী উপায়ে মহাকাশাভিযান, দ্বিতীয়ত সাফল্যের হার— উভয়ের প্রেক্ষিতেই গোটা বিশ্বের নজর কেড়েছিল ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা।
প্রাথমিকভাবে ভারতের এই উত্থানকে ব্যাঙ্গাত্মক দৃষ্টিতে দেখলেও অভিমত পাল্টায় পশ্চিমী দুনিয়া। তার মুখ্যত দুটি কারণ। এক, চিন এবং রাশিয়ার বিপরীতে লোকতন্ত্রে চালিত হয় ভারত। ফলে মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে রাজনৈতিক মতানৈক্যের জায়গা নেই। দ্বিতীয়ত, অর্থনীতির দিক থেকেও যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষ হতে গেলে তিন-চার দশক সময় লাগবে ভারতের। ফলে সুপার-পাওয়ার হিসাবে ভারত চ্যালেঞ্জ জানাবে যুক্তরাষ্ট্রকে— এমন সম্ভাবনাও ক্ষীণ। উল্টোদিকে গবেষণার ফলাফল প্রকাশের ক্ষেত্রে চিনের মতো গোপনীয়তা অবলম্বন না-করায়, চন্দ্রাভিযানে ইসরো সাফল্য পেলে আখেরে তাতে উপকৃত হবে পশ্চিমী বিশ্ব। কীভাবে?
একটু খুলে বলা যাক। চাঁদের মাটি রেগোলিথে রয়েছে ম্যাগনেশিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম, সিলিকন, ক্যালশিয়াম, প্ল্যাটিনাম-সহ বহু গুরুত্বপূর্ণ খনিজ। রয়েছে বিরল মৃত্তিকা মৌল ও হিলিয়ামের আইসোটোপ। আগামীদিনে যা হয়ে উঠতে পারে খনিজ এবং শক্তির অন্যতম উৎস। তবে এই সম্পদ কীভাবে মানব সভ্যতার স্বার্থে ব্যবহার করা যেতে পারে— তা নিয়ে গবেষণার বিস্তর অবকাশ আছে বইকি। সেই গবেষণা চালানোর জন্য প্রয়োজন একাধিক চন্দ্রাভিযানের। প্রয়োজন বিপুল পরিমাণ অর্থেরও। সাম্প্রতিক সময়ে চন্দ্রাভিযানের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে ইজরায়েল বা জাপানের মতো মতো যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র-রাষ্ট্র। ফলে, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সবেধন নীলমণি ভারতই। ইসরোর অভিযান সফল হলে, গবেষণায় বাড়তি সুবিধা পাবে নাসা— তাতে আর আশ্চর্য কী!
পাশাপাশি চন্দ্রযান ৩ অবতরণ করবে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে। আজ পর্যন্ত কোনো দেশই পৌঁছাতে পারেনি এই অঞ্চলে। অথচ, সেখানেই নাকি লুকিয়ে বরফ— এই সম্ভাবনা প্রবল। আগামীতে চাঁদে বসতি তৈরি করা কিংবা মহাকাশযানের জ্বালানির জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন সরবরাহের অন্যতম উৎস হয়ে উঠতে পারে এই অঞ্চল। সেদিক থেকেও চন্দ্রযান ৩-এর গুরুত্ব কম নয়। ফলে ১৪০ কোটি ভারতবাসীর সঙ্গে ইসরোর সাফল্য কামনা করছে নাসা, ইএসএ-সহ বিশ্বের অন্যান্য মহাকাশ গবেষণা সংস্থাও।
এই একই ধরনের অভিযানে সামিল হয়েছিল রাশিয়াও। তবে গত ২০ তারিখে চাঁদের বুকে আছড়ে পড়ে রাশিয়ার লুনা-২৫ ল্যান্ডার। তা নিয়ে বিগত কয়েকদিন ধরেই বিদ্রূপ-তামাশায় মেতে রয়েছে পশ্চিমী দুনিয়া। সফল হলে বিজ্ঞানের নিরিখে এই অভিযান গুরুত্বপূর্ণ হতে পারত, তা নিয়ে সন্দেহ নেই কোনো। তবে তা-সত্ত্বেও তা নিয়ে প্রথম থেকেই সেভাবে আগ্রহ ছিল না পাশ্চাত্যের। এমনকি পশ্চিমের সংবাদমাধ্যম বার বার ভারত-রাশিয়ার দ্বৈরথ হিসাবেই দেখাতে চেয়েছে রাশিয়ার এই অভিযানকে। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব তো রয়েছেই, তাছাড়াও রাশিয়া ঘোষণা করেছিল, এই গবেষণা এবং অভিযানের তথ্য পশ্চিমী দুনিয়ার সঙ্গে ভাগ করবে না তারা। ফলে স্বার্থসিদ্ধির সুযোগের অভাবেই লুনা ২৫-এর থেকে মুখ ফিরিয়েছিল পাশ্চাত্য।
বলার অপেক্ষা থাকে না, আন্তর্জাতিক রাজনীতির এই জটিলতার মাঝে দাঁড়িয়ে চন্দ্রযান ৩-এর গুরুত্ব বেড়ে যায় আরও। এই অভিযান সফল হলে, আগামীদিনে মহাকাশ বাণিজ্যে নিজের জায়গা আরও খানিকটা পাকা করে ফেলবে ইসরো। ইসরোকে কেন্দ্র করে দেশে গড়ে উঠবে ছোটো-বড়ো শিল্প, বদলাবে অর্থনীতি— সেই সম্ভাবনাও প্রবল। তাছাড়া রাজনৈতিক বা সামরিক স্বার্থকে ছাপিয়ে বিজ্ঞান অনুসন্ধানই প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত— কোথাও গিয়ে বিশ্বকে সেই পাঠও দিচ্ছে ভারতীয় মহাকাশ সংস্থা। সবমিলিয়ে মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক অধ্যায় হয়ে ওঠার সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে চন্দ্রযান-৩।
Powered by Froala Editor