সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড বিউরোর সমীক্ষার ফলাফল। সেই রিপোর্ট থেকেই উঠে আসছে ২০১৯ সালে ভারতে আত্মহত্যার সংখ্যা তার আগের বছরের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে ৩.৪ শতাংশ। যদিও রাজ্যে গত বছরের তুলনায় কমেছে আত্মহত্যার সংখ্যা। তাও মহারাষ্ট্র এবং তামিলনাড়ুর পরেই ভারতের মধ্যে তৃতীয় স্থানে রয়েছে রাজ্যের নাম। সেদিক থেকে দেখতে গেলে ভারতের মধ্যে অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র এবং ঝাড়খণ্ডে এক ধাক্কায় অনেকটাই বেড়েছে আত্মহত্যার হার।
২০১৬ সালের পর অনেকটাই কমেছিল আত্মহত্যার ঘটনা। কিন্তু গত দু’বছরই টানা বাড়ল আত্মহননের সংখ্যা। ২০১৮ সালে ভারতে আত্মহত্যার সংখ্যা ছিল ১ লক্ষ ২৯ হাজার ৮৮৭। ২০১৯-এ সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লক্ষ ৩৪ হাজার ৫১৬। প্রতিদিন যার গড় সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৮১ জন। এই রিপোর্টের বিশ্লেষণে উঠে আসছে আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে ৭০ শতাংশ পুরুষ। যার মধ্যে বিবাহিত ৬৮ শতাংশ। বিবাহিত মহিলাদের মধ্যেও আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। ৬২ শতাংশ মহিলা আত্মহত্যাকারিণীই বিবাহিত। ৩২ শতাংশ ঘটনার পিছনে রয়েছে সাংসারিক দ্বন্দ্ব। স্পষ্টতই বোঝা যায়, গার্হস্থ্য হিংসা এবং দাম্পত্যকলহ আত্মহত্যার একটি বড়ো কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অন্যদিকে গ্রামাঞ্চলের তুলনায় শহরে আত্মহত্যার সংখ্যা অনেকটাই বেশি। শহরের গতিময়তা, ইঁদুরদৌড়ের লড়াই, কর্পোরেট কর্মক্ষেত্রের চাপই কি সেক্ষেত্রে আত্মহত্যাপ্রবণ করে তুলছে মানুষকে? তৈরি করছে বাড়তি মানসিক চাপ? থেকে যাচ্ছে এই প্রশ্নও। শহরের ব্যয়-বহুলতার কারণেও আত্মহত্যার ঘটনা চোখে এসেছে কিছু ক্ষেত্রে। অন্যদিকে অসুস্থতা থেকেও অবসাদগ্রস্ত হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন ১৭ শতাংশ মানুষ।
তবে এই রিপোর্ট আরও একবার বুঝিয়ে দিল অনেকক্ষেত্রে আত্মহত্যা ঠেকানোর আরও একটি বড়ো হাতিয়ার হতে পারে শিক্ষা। স্নাতক বা স্নাতকোত্তর স্তরের পড়াশোনা করা ব্যক্তিদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা অনেকটাই কম। প্রায় ৪ শতাংশ। অন্যদিকে আত্মহত্যা করা ৩০ শতাংশ মানুষই হয় নিরক্ষর কিংবা তাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রাথমিক স্তর অবধি। পড়ুয়াদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনাও বেশি ঘটেছে উচ্চ-মাধ্যমিক স্তর বা তার নিচে। পরিণত মানসিকতা তৈরি হওয়ার আগেই অনেকে শিকার হচ্ছেন মানসিক অবসাদের। নিজেদের ব্যস্ততা কি সন্তানদের একাকিত্বের দিকে ঠেলে দিচ্ছে তবে? সংকীর্ণ হয়ে আসছে পারিবারিক যোগাযোগ?
আরও পড়ুন
শুধু জুন মাসেই কলকাতায় আত্মহত্যা করেছেন ৪৫ জন, জানাল লালবাজার
তবে সুশান্তের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের আত্মহত্যাও প্রভাবিত করেছে অনেককেই। তাঁরা স্বপ্নের চরিত্রদের আত্মহননের ঘটনাকে অনুসরণ করেছেন। সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যুর পরেই এক ধাক্কায় বেড়ে গিয়েছিল ইন্টারনেটে ‘সুইসাইড’, ‘আত্মহত্যা’, ‘কপিক্যাট ডেথ’-এর মতো শব্দবন্ধ লিখে সার্চ করার প্রবণতা। অন্যদিকে সাহায্য খুঁজে জীবনের দিকে ফিরতে পারার উপায়ও খুঁজেছেন অনেকে।
আরও পড়ুন
লকডাউনে আর্থিক অনটন, কলকাতায় আত্মহত্যার চেষ্টা মা সহ দুই ছেলের
আত্মহত্যার ক্ষেত্রে মানসিক রোগ দায়ী থাকলেও তার সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। আর্থিক এবং ব্যক্তিগত সমস্যার বহিঃপ্রকাশ না হওয়ার থেকেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জমতে শুরু করে অসহায়তার পাহাড়। আর ধীরে ধীরে আত্মহত্যাপ্রবণ হতে থাকেন মানুষ। এই চক্রব্যূহ থেকে বেরিয়ে আসার, অন্যদের বের করে আনার একমাত্র রাস্তা হতে পারে সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং পরিবেশগত দিকগুলিতে নজর দেওয়া। প্রয়োজন প্রত্যেকেরই সংবেদনশীল হওয়ার। সামাজিকভাবে কোনো ভিকটিমকে গ্রহণ না করে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁকে বিচার করা হয় স্টিগমাটিকভাবে। অপদস্ত করা হয় বিভিন্নভাবে। এই ঘটনাও কি যথেষ্ট না একজনকে খাদের দিকে ঠেলে দিতে?
আরও পড়ুন
মেলেনি করোনার চিকিৎসা, মেঝেতে সুইসাইড নোট লিখে আত্মহত্যা কলকাতার একই পরিবারের তিনজনের
২০১৯ সালের রিপোর্টেই আত্মহত্যার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৩.৪ শতাংশ। তবে এই বছর সেই সংখ্যা বাড়ার সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে। লকডাউন, গৃহবন্দিদশা একদিক থেকে যেমন অবসাদের শিকার করে তুলেছে মানুষকে। তেমনই আরও বাড়িয়ে দিয়েছে গার্হস্থ হিংসার ঘটনা। শুধুমাত্র জুন মাসেই কলকাতায় ঘটেছে ৬০টি আত্মহত্যার ঘটনা। শুধু কলকাতা নয় সারা দেশের ক্ষেত্রেই এই চিত্র অনেকটাই এক। এই ঊর্ধ্বমুখী রেখাচিত্র আটকানোর জন্য সরকার ব্যবস্থা করেছে ফ্রি-হেল্পলাইনেরও। কিন্তু তার পরেও আয়ত্তে আসছে না সংখ্যা। ফলে বলাই বাহুল্য প্রথাগত শিক্ষার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সচেতনতা, সহমর্মিতার মতো দিকগুলিতেও আলোকপাত করা জরুরি হয়ে উঠেছে। সে ব্যাপারে সত্যিই কি কিছু ভাবছে সরকার, প্রশাসন? জানা নেই...
Powered by Froala Editor