আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তার ধারে ছোট্ট একটি ভিউ পয়েন্ট। দূরে সাদা বরফে মোড়া পর্বত শৃঙ্গের দেখা মেলে সেখান থেকে। দেখা যায় পাহাড়জুড়ে ছড়িয়ে থাকা স্থানীয় মানুষদের ছোটো ছোটো ঘরবাড়ি, উপত্যকা, খরস্রোতা নদীকে। তবে এই ভিউ পয়েন্টে হাজির হলেই চোখে পড়তে বাধ্য প্রকাণ্ড একটি ম্যুরাল। পাহাড়ের পাথুরে দেওয়ালেই আঁকা হয়েছে একটি ছবি। ছবিটির কেন্দ্রে রয়েছে অমরেশ পুরী অভিনীত মিস্টার ইন্ডিয়া ছবির চরিত্র ‘মোগাম্বো’। তাঁর পাশেই লেখা, ‘কুড়ে কো কুড়েদান মে ডালা, তো মোগাম্বো খুশ হুয়া’। কথাটার বাংলা করলে দাঁড়ায়, ডাস্টবিনে বর্জ্য ফেলা হলে মোগাম্বো খুশি হবে। আর এই ম্যুরালের পাশেই রাখা বেশ কয়েকটি বড়ো বড়ো ডাস্টবিন।
উত্তরাখণ্ড, হিমাচলপ্রদেশ কিংবা লাদাখের পার্বত্য অঞ্চলে গেলেই দেখা মিলবে এই দৃশ্যের। নেপথ্যে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘ওয়েস্ট ওয়ারিয়র’ (Waste Warrior)। মূলত পর্বতারোহী, অভিযাত্রী ও পরিবেশবিদদের নিয়ে তৈরিই তৈরি এই সংস্থা। স্থানীয় মানুষ এবং পর্যটকদের সচেতন করার পাশাপাশি হিমালয় থেকে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ এবং ব্যবস্থাপনা করে থাকেন এই সংস্থার সদস্যরা। বিগত ১০ বছরে ৬০ লক্ষ কেজি বর্জ্য (Wastes) সংগ্রহ করে এবার নতুন নজির গড়লেন তাঁরা।
আনুষ্ঠানিকভাবে ২০১২ সালে এই সংস্থার পথচলা শুরু হলেও, ২০০৮ সালেই এই সংস্থার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন ব্রিটিশ অভিযাত্রী জোডি আন্ডারহিল। ভারতভ্রমণের সময় হিমালয়ের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হলেও, তাঁর নজর কেড়েছিল জায়গায় জায়গায় জমে থাকা টন টন প্লাস্টিক বর্জ্য। ভারতীয় হিমালয়ের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে একটি বিশেষ সমীক্ষাও করেছিলেন তিনি। তুলে এনেছিলেন, এই প্লাস্টিক বর্জ্য হিমালয়ের দৃষ্টিনান্দনিকতাকে যেমন খর্ব করছে, তেমনই বড়ো বিপদের কারণ হয়ে উঠছে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের পরিবেশের পক্ষেও।
এই সমীক্ষার পর থেকে ভারতের স্থানীয় মানুষদের সচেতন করার লড়াই শুরু করেন তিনি। পরবর্তীতে ভারতীয় পর্বতারোহী এবং অভিযাত্রীদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন জোডি। তৈরি হয় ‘ওয়েস্ট ওয়ারিয়র’। মূলত দুটি ভাগ রয়েছে এই সংস্থার। মূল সংস্থার অভিযাত্রীরা প্রতিবছর হিমালয়ের বিভিন্ন অঞ্চলে ট্রেকিং করতে যাওয়ার সময় সংগ্রহ করে আনেন প্লাস্টিক এবং প্যারাস্যুট কাপড় জাতীয় বর্জ্যপদার্থ। অন্যদিকে স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে তৈরি ‘মাউন্টেন ক্লিনার’ নামের স্বেচ্ছাসেবী শাখাসংস্থাটি স্থানীয় বর্জ্য সংগ্রহের কাজ চালায়।
প্রাথমিকভাবে হিমাচল প্রদেশের ত্রিউন্ড এবং ধর্মশালায় তৈরি হয়েছিল এই সংস্থার কেন্দ্র। এই দুটি অঞ্চলেই মূলত সাপ্তাহিকভাবে চলত বর্জ্য সংগ্রহ এবং প্রক্রিয়াকরণের কাজ। পরবর্তীতে ক্রমশ বড়ো হতে থাকে এই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার আকার। বর্তমানে দেশের ১৩টি হিমালয়ান রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্যে ৯টিতেই রয়েছে এই সংস্থার কেন্দ্র। সবমিলিয়ে সক্রিয় কর্মীদের সংখ্যা প্রায় ১৬০-এরও বেশি। তাছাড়া স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে কাজ করেন কয়েক হাজার স্থানীয় মানুষ। তাঁদের সকলের সহযোগিতাতেই বিগত ১০ বছরে সবমিলিয়ে ৬০ লক্ষ কেজি বর্জ্য সংগ্রহ করেছে এই সংস্থা।
তবে এই সংখ্যাটা যথেষ্ট নয় মোটেই। এমনটাই দাবি ‘ওয়েস্ট ওয়ারিয়র’-এর পরিচালক অঙ্গদ খান্নার। কারণ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি বছর হিমালয়ে তৈরি হয় প্রায় ৮৪ লক্ষ মেট্রিক বর্জ্য। যার অধিকাংশই আসলে প্লাস্টিক ও প্যারাস্যুট কাপড়ের মতো জৈব-অবিয়োজ্য আবর্জনা। বিগত ১০ বছরে তার সিকিভাগও সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়নি এই সংস্থা। তবে সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্রমশ বাড়ছে সচেতনতা। সচেতন হচ্ছেন পর্যটকরাও। যার ফলস্বরূপ আগামীতে হিমালয়ের পরিবেশ ও স্বাস্থ্য বদলাবে বলেই আশাবাদী তিনি।
Powered by Froala Editor