পশ্চিমবঙ্গ এক বিরাট ইতিহাসের খনি। এখানকার মাটির তলায় এখনও কত ইতিহাস লুকিয়ে আছে। ওপরেও যা রয়েছে, তার তুলনা মেলা ভার। ঠিক যেমন মুর্শিদাবাদ। একটা সময় বাংলা-বিহার-ওড়িশা জুড়ে রাজত্ব চলত নবাবদের। আর তারই প্রাসাদ, জায়গা ছড়িয়ে আছে এখানে। কত লোকে এসেছে, কত লোকে গেছে। আর সেই চিহ্ন ছড়িয়ে আছে মুর্শিদাবাদ জুড়ে…
মুর্শিদাবাদে এলে যে নবাবি প্রাসাদগুলো দেখা যায়, তারই একটির দিকে নজর দেব আমরা। সাদা রঙের দোতলা প্রাসাদ। সামনে প্রশস্ত বাগান, এখন অবশ্য সেই রূপ বদলে গেছে জঙ্গলে। আর আছে একটি অন্ধ প্রাসাদ। নাম ‘ওয়াসিফ মঞ্জিল’। ইতিহাস বলে, প্রাসাদটি তৈরি করেছিলেন ওয়াসিফ আলি মির্জা। তাঁর পরিচয়? ইনি ছিলেন মুর্শিদাবাদের নবাবি সিংহাসনের অন্যতম উত্তরাধিকার। নবাব বংশের ইতিহাসের শেষ সময়গুলোর সাক্ষী ছিলেন তিনি।
ওয়াসিফ আলি মির্জা যখন জন্ম নিলেন, ততদিনে বাংলার নবাবের প্রতিপত্তি অনেকটাই কমে গেছে। সিরাজ-উদ-দৌলা, মীরজাফরের সময় অতীত। ইংরেজ সরকারও জাঁকিয়ে বসেছে অনেকটা। এমন সময়ই মসনদে এসেছিলেন ওয়াসিফ আলির বাবা, নবাব হাসান আলি মির্জা। মুর্শিদাবাদের পাশাপাশি কলকাতার পার্ক স্ট্রিটে, মুর্শিদাবাদ হাউসেও চলত কাজকর্ম। তখনও খাতায়-কলমে ‘বাংলার নবাব’ পদটি বজায় ছিল। ১৮৮০ সালে, অর্থাৎ ওয়াসিফ আলি মির্জার জন্মের পাঁচ বছর পর সেই পদটিও চিরকালের মতো চলে যায়। নবাবরা তখন কেবলমাত্র মুর্শিদাবাদেরই। তাঁর তখন পরিচয় ‘মুর্শিদাবাদের নবাব’; কেবল হাজারদুয়ারি থেকে যায় সঙ্গে…
নবাবি পরিবারে জন্মালেও, ছোটো থেকেই বিলেতি আদবকায়দার সঙ্গে পরিচিতি ওয়াসিফ আলি মির্জার। বয়স যখন ১২, তখনই ছোটো ভাইয়ের সঙ্গে পাড়ি দেন ইংল্যান্ড। তারপর শেরবর্ন স্কুল, রাগবি স্কুল, ট্রিনিটি কলেজ থেকে পড়াশোনা করেন। তবে এটুকু বললেই সব বলা হয় না। এই পুরো সময়টায় ইউরোপীয় সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান ওয়াসিফ আলি মির্জা। ছেলের মধ্যে এই অতিরিক্ত বিদেশি প্রভাবের খবর পেতেন নবাব হাসান আলি মির্জা। মুসলিম ধর্মের সেরকম কিছুই মানছেন না। এ তো গুনাহ! আর সেই ‘অপরাধ’ খণ্ডনের জন্য আসরেও নেমেছিলেন নবাব বাহাদুর। শোনা যায়, রমজানের সময় প্রতিদিন প্রায় ৬০ জন লোককে খাওয়ানোর ভার নিতেন তিনি। মুর্শিদাবাদের কোষাগারের হাঁড়ির হাল; তবুও খরচ করতে দ্বিধা করলেন না…
একসময় দেশে ফিরলেন ওয়াসিফ আলি মির্জা। তখনও তিনি শাহজাদা; কিন্তু ভেতরে সাহেবি হাওয়া প্রবল। পোলো খেলায় অসম্ভব পটু ছিলেন তিনি। তবে সেইসঙ্গে আরও একটি বদল আনলেন। পুরনো প্রাসাদে আর থাকতে চাইলেন না। ঠিক করলেন, নিজের মনমতো একটি প্রাসাদ তৈরি করবেন। ওই এলাকারই একটি পুরনো ভাঙা প্রাসাদকে গড়েপিঠে নিলেন ওয়াসিফ। তৈরি হল বিখ্যাত ‘ওয়াসিফ মঞ্জিল’। আর এর কয়েক বছরের মধ্যে, হাসান আলি মির্জার মৃত্যুর পর মুর্শিদাবাদের মসনদেও বসলেন তিনি। হলেন এখানকার দ্বিতীয় নবাব বাহাদুর (কারণ ততদিনে বাংলার নবাব তকমা চলে গিয়েছিল। বদলে এসেছিল মুর্শিদাবাদের নবাব। আর সেটা শুরু হয়েছিল হাসান আলি মির্জার সময় থেকে)।
১৯৩৭ সাল। বিশ্বের আকাশে একটু একটু করে দানা বাঁধছে বিশ্বযুদ্ধের মেঘ। আর ভারতের বুকে ক্রমশ জোরালো হচ্ছে স্বাধীনতার আওয়াজ। একদিকে নরমপন্থী নেতাদের আলাপ-আলোচনা; অন্যদিকে বিপ্লবী কার্যকলাপ। তার মধ্যেই যেন দেখা দিল অসন্তোষ। হিন্দু আর মুসলিম— দুই ধর্মের মানুষদের মধ্যে একটু একটু করে তৈরি হচ্ছিল জটিলতা। মহম্মদ আলি জিন্নাহের নেতৃত্বে মুসলিম লীগও সংখ্যালঘুদের পক্ষ নিচ্ছিল। এমন পরিস্থিতিতেই এগিয়ে এলেন নবাব ওয়াসিফ আলি মির্জা খান বাহাদুর। ওই বছরেই তৈরি করলেন ‘আঞ্জুমান-ই-মুসলমান-ই-বাংলা’ সংগঠন। এর প্রধান লক্ষ্যই ছিল হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি অক্ষুণ্ণ রাখা। নবাব ওয়াসিফ আলিই এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি ছিলেন।
আরও পড়ুন
হনুমান মন্দির ঘিরে দাঙ্গা-পরিস্থিতি অযোধ্যায়; নবাব ওয়াজেদ আলী শাহের হস্তক্ষেপে এল সমাধান
কিন্তু ভবিতব্যকে কে-ই বা আটকে রাখতে পারে! মুর্শিদাবাদের ক্ষমতাই বা কতটুকু তখন! নিজের সাধের ‘ওয়াজির মঞ্জিল’ও ছেড়ে দিয়েছেন নবাব বাহাদুর। চলে এসেছেন কলকাতায়। পার্ক স্ট্রিট অঞ্চলের মুর্শিদাবাদ হাউসেই চলছে সব কাজ। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এখানেই থাকবেন তিনি। এমন সময় হাজির হল ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট। দেশ স্বাধীন হল বটে; কিন্তু র্যা ডক্লিফের ছুরি দেশটিকে টুকরো টুকরো করে দিল। আর এখানেই কোপ পড়ল মুর্শিদাবাদের ওপর। ঠিক করা হল, মুর্শিদাবাদ জেলাটি পাকিস্তানের অধীনে থাকবে। সেহেতু, হাজারদুয়ারি প্রাসাদের ওপরও উড়ল পাকিস্তানের পতাকা।
কিন্তু নবাব তো কখনই চাননি এমনটা! তাঁকে তো কেউ জিজ্ঞেসও করল না। এক সময় যে পরিবার গোটা বাংলা-বিহার-ওড়িশা শাসন করত, প্রবল পরাক্রমশালী সেই নবাবদের এই হাল! অবশ্য এই অবস্থা বেশিদিন থাকেনি। দুদিন পর, ১৭ আগস্টে মুর্শিদাবাদ আবার ভারতে চলে আসে। পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে হাজারদুয়ারিতে ওড়ে ত্রিবর্ণরঞ্জিত ভারতের পতাকা। কয়েক বছর পর সমস্ত জমিজমা নবাবকে ফেরত দিয়ে দেয় ভারত সরকার।
আর নবাব? ওয়াসিফ আলি মির্জার জীবন তখন শেষ লগ্নে। হয়তো ভাবছেন পুরনো সেই দিনের কথা। যে দিনগুলোর কথা অনেক শুনেছেন, কিন্তু চোখে দেখেননি। মুর্শিদাবাদের নবাবি ইতিহাসের শেষ পর্যায়ের অন্যতম প্রতিনিধি তিনি। তাঁর ছেলে ওয়াজির আলি মির্জাই ছিলেন শেষ নবাব। কলকাতার মুর্শিদাবাদ হাউসে বসেই সূর্যাস্ত দেখছেন ওয়াসিফ আলি মির্জা খান বাহাদুর। সাধের প্রাসাদ তখন বহুদূরে…
আরও পড়ুন
কলকাতায় নির্বাসিত ওয়াজেদ আলি শাহ, নবাবি শখেই তিলোত্তমা পেল ঘুড়ির উত্তেজনা
তথ্যসূত্র –
১) ‘West Bengal continues Nawabi Ramzan legacy’, Parwez Hafeez, The Asian Age
২) ‘নবাবের ওয়াসিফ মঞ্জিলে একদিন’, ফারুক আবদুল্লাহ, যথা ইচ্ছা তথা যা
৩) উইকিপিডিয়া
Powered by Froala Editor