‘আমাদের ছোটো নদী চলে আঁকেবাঁকে/ বৈশাখ মাসে তাঁর হাঁটু জল থাকে…’
বিগত কয়েক দশকে অনেকটা এরকমই চেহারা নিয়েছে ইউক্রেনের (Ukraine) ইরপিন নদী (Irpin River)। ধীরে ধীরে হারিয়েছে তার গতি। কমেছে জলের পরিমাণও। তবে এক সময় এই নদীরই চেহারা ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম। ইউক্রেনের বাস্তুতন্ত্রে গুরুত্ব কম যেত না। গত মার্চ মাসের কথা। সদ্য শুরু হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। রুশ বাহিনীর একটা বড়ো অংশ জমা হয়েছিল ইউক্রেনের উত্তর সীমান্তে। লক্ষ্য ছিল, ইরপিন পেরিয়ে ইউক্রেনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করা। তবে হঠাৎ করেই দুকূল ছাপিয়ে বন্যা আসে ইরপিনে। পিছু হটতে বাধ্য হয় রুশ সেনারা। নদীখাতেই আটকে পড়ে রাশিয়ার বহু ট্যাঙ্ক, ভারি অস্ত্র ও সেনাদের অন্যান্য সরঞ্জাম।
না, ‘অ্যাক্ট অফ গড’ নয়। রুশ বাহিনীকে প্রতিহত করতেই কূটনৈতিকভাবে এই পদক্ষেপ নিয়েছিল ইউক্রেন সরকার। ব্যবহার করা হয়েছিল প্রকৃতিকে। ভিন্ন একটি ড্যাম খুলে জল ছাড়া হয়েছিল এই নদীতে। আর সেই কারণেই বিগত ৭০ বছরে প্রথমবারের জন্য প্লাবিত হয় ইরপিন নদী।
যুদ্ধের জন্য কিংবা রাজনৈতিক স্বার্থে প্রকৃতির ব্যবহার এই প্রথম নয়। দুই বিশ্বযুদ্ধ তো বটেই, তাছাড়া আধুনিক ইতিহাসে বিভিন্ন সময়েই দেখা গেছে প্রকৃতিকে ব্যবহার করার এ-ধরনের ঘটনা। যুদ্ধ-বিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে বলা হয় ‘ওয়ার-ওয়াইল্ডিং’ (War-Wilding)। যার অন্যতম উদাহরণ ইরানের ‘মার্শ অ্যারাব’ কিংবা কৃত্রিম অ্যাভালাঞ্চ। যুদ্ধ এমনিতেই ভয়াবহভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে প্রকৃতিকে। এক ধাক্কায় বৃদ্ধি পায় আঞ্চলিক কার্বন নির্গমনের মাত্রা। ত্বরান্বিত হয় জলবায়ু পরিবর্তনও। বিশেষত ‘ওয়ার-ওয়াইল্ডিং’ সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দিতে পারে কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলের বাস্ততন্ত্রকে। তবে ইউক্রেনের ইরপিন নদীর ক্ষেত্রে ঘটনাটা একটু অন্যরকম।
প্লাবনের ফলে শুধু নদীর জলতলই যে বৃদ্ধি পেয়েছে তা নয়, ইরপিন নদীর দু’ধারে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য জলাভূমিও প্রাণ ফিরে পেয়েছে ৭০ বছর পর। বিগত ৫ মাসে সম্পূর্ণভাবে বদলে গেছে তাদের চেহারাও। সবুজ চাদর গজিয়ে উঠেছে গোটা অঞ্চলের মাথায়। লন্ডনের যুদ্ধ মারজান স্টাডি গ্রুপের অধ্যয়ন বিভাগের প্রোগ্রাম ডিরেক্টর জ্যাম্পারের ভাষায়, ইউক্রেনের এই পদক্ষেপ নতুন করে প্রাণ ফিরিয়েছে গোটা অঞ্চলটির। আসলে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের প্রকৃতি সংরক্ষণে বহু আগে থেকেই উদ্যোগী হওয়ার প্রয়োজন ছিল ইউক্রেন প্রশাসনের। তবে সেই খামতি ভরিয়ে দিল ‘ওয়ার-ওয়াইল্ডিং’। যুদ্ধ শেষ হলে অঞ্চলটিকে যাতে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের স্মারক হিসাবে ঘোষণা করা হয় সেই আবেদনই করছেন, বিশ্বের বিজ্ঞানীমহল। ইরপিন সংলগ্ন এই জলাভূমির সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ করা হলে, আগামীতে যুদ্ধের ক্ষত অনেকটাই সারিয়ে তুলতে পারবে সাবেক সোভিয়েত অঙ্গরাজ্যটি, এমনটাই অনুমান তাঁদের…
Powered by Froala Editor