ভারত তো বটেই, আগামীদিনে তীব্র জলসংকটের মুখে পড়তে চলেছে গোটা বিশ্ব। সাম্প্রতিক সময়ে বারবার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণায় ঘুরে ফিরে এসেছে এই সংবাদ। উজবেকিস্তানের আরল সাগরই হোক কিংবা লাতিন আমেরিকার পোপো হ্রদ— বিশ্বজুড়ে ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্ছে একের পর এক জলাধার। সেইসঙ্গে ফুরিয়ে আসছে ভূগর্ভস্থ জলের ভাণ্ডারও। কিছুদিন আগেই এক গবেষণাপত্রে গবেষকরা করেছিলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের এই ধারা বজায় থাকলে আগামীতে জল সম্পদ নিয়ে যুদ্ধে (War) জড়িয়ে পড়তে পারে বিভিন্ন রাষ্ট্রও।
এবার আর সম্ভবনা নয়, বাস্তবেই ঘটল এমনটা। জলের অধিকার নিয়ে গুলির লড়াই শুরু হল ইরান (Iran) এবং তালিবান শাসিত আফগানিস্তানের (Afghanistan) মধ্যে। গতকাল জলসংকটকে কেন্দ্র করেই দুই দেশের নিরাপত্তা বাহিনীদের মধ্যে কথা কাটাকাটি শুরু হয়। উত্তাপ বাড়তে বাড়তে শুরু হয় গুলির লড়াই। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। আর সেই গুলির লড়াইয়ে প্রাণ হারান ২ ইরানি সেনা-সহ ৩ ব্যক্তি। আহত আরও বেশ কয়েকজন। তবে এখানেই শেষ নয়। তালিবান মুখপাত্র আব্দুল নাফির বক্তব্য অনুযায়ী, ইরানকে উপযুক্ত জবাব দিতে প্রস্তুত আফগানিস্তান। এমনকি ইতিমধ্যে সীমান্তে প্রচুর পরিমাণে আগ্নেয়াস্ত্র সরবরাহও শুরু করেছে তালিবানরা। প্রশ্ন থেকে যায়, জল সংকট নিয়ে হঠাৎ কেন যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ল এই দুই দেশ?
উত্তর পেতে নজর দিতে হবে আফগানিস্তানের মানচিত্রে। হেলমন্দ আফগানিস্তানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং দীর্ঘতম নদী। আফগানিস্তানের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এই নদী প্রবেশ করে ইরানে। অন্যদিকে উত্তর-পূর্ব ইরানের সিস্তান এবং বালুচিস্তান প্রদেশের একমাত্র নদীই হল হেলমন্দ। ফলে, নদীর জল ব্যবহারের অধিকার কোন দেশের কাছে থাকবে— তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই দ্বন্দ্ব চলে আসছে এই দুই দেশের মধ্যে।
এই দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয় পঞ্চাশের দশকে। আফগানিস্তানে হেলমন্দের ওপরেই তৈরি হয়েছিল কাজাকি বাঁধ। তাতে ইরানে জলের প্রবাহ কমে যায় অনেকটাই। পরবর্তীতে হেলমন্দ নদীর ওপর আরও বেশ কয়েকটি বাঁধ গড়ে তোলে আফগানিস্তান সরকার। যার মধ্যে বেশ কয়েকটি বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে বড়ো ভূমিকা রেখেছিল আমেরিকাও। জল-সরবরাহ বন্ধ করে ইরানের ওপর চাপ তৈরি করতেই এই পরিকল্পনা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের, এমনটাও দাবি করেন অনেকে।
অবশ্য আফগানিস্তানে গণতান্ত্রিক সরকার থাকার সময় জলসংকট নিয়ে দুই দেশের মধ্যে স্থাপিত হয়েছিল বিশেষ সমঝোতা। তালিবান ক্ষমতায় আসার পর থেকেই লঙ্ঘিত হতে থাকে ১৯৭৩ সালে স্বাক্ষরিত হওয়া সেই চুক্তি। বিশেষত ইরান-আফগানিস্তান সীমান্তে অবস্থিত ‘কামাল খান’ বাঁধের মাধ্যমে ইরানে জলের প্রবাহ প্রায় ন্যূনতম করে দেয় তালিবান সরকার।
তালিবানের এই পদক্ষেপে, বিগত কয়েকমাস ধরেই তীব্র জলসংকট দেখা গিয়েছিল উত্তর-পূর্ব ইরানের ৯৭ শতাংশ অঞ্চল। সরকারি নথি অনুযায়ী, তীব্র জলাভাবের শিকার ইরানের প্রায় ২৭০টি শহর। এমনকি ইরানের জনসংখ্যা আফগানিস্তানের দ্বিগুণ হলেও, সে-দেশের মিষ্টি জলের আধার প্রায় অর্ধেক। এই জলাভাবের কারণেই সাম্প্রতিক শহর ছাড়তে বাধ্য হন হাজার হাজার ইরানের মানুষ। ব্যাহত হয়েছে কৃষিকাজও।
সংশ্লিষ্ট বিষয়টি নিয়েই সীমান্তবর্তী এলাকায় শুরু হয়েছিল দুই পক্ষের সেনাদের মধ্যে বাকযুদ্ধ। আর সেখানেই থেকেই সূত্রপাত লড়াইয়ের। যুদ্ধ বিশারদদের মতে, আগামীতে বড়ো আকার নিতে পারে ইরান ও আফগানিস্তানের এই ‘ওয়াটার-ওয়ার’। এমনকি ইরান ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে ধ্বংস করতে পারে আফগানিস্তানের বেশ কয়েকটি বাঁধ, দেখা দিচ্ছে সেই সম্ভাবনাও।
এর আগে জলসংকট নিয়ে দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হয়েছে ইথিওপিয়া ও মিশর, চিন ও ভিয়েতনাম, তুরস্ক ও ইরাক সহ একাধিক দেশ। সিন্দু নদের জলের অধিকার নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের দ্বন্দ্বও গোটা বিশ্বের নজর কেড়েছে একাধিকবার। অবশ্য এখনও পর্যন্ত যুদ্ধের পরিস্থিতিতে পৌঁছায়নি কোনোটাই। সেদিক থেকে দেখতে গেলে জলসংকটকে কেন্দ্র করে প্রথমবার আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার হল এই প্রথম। এমনকি দেখা দিল পূর্ণমাত্রার যুদ্ধের সম্ভাবনাও। যদিও এই সংঘর্ষের পিছনে আরও বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সমীকরণ রয়েছে বলেও মনে করেছেন বিশেষজ্ঞরা। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে রুশ বাহিনীকে ক্রমাগত ড্রোন ও গোলাবারুদ দিয়ে সাহায্য করেছে ইরান। সেই সূত্রেই কি বৃহত্তর সমীকরণের সুতোয় টান পড়েছে? আফগানিস্তানের আগ্রাসনের পিছনে কি কোনোভাবে লুকিয়ে রয়েছে পশ্চিমী দুনিয়ার হাত? সে-উত্তর দেবে সময়ই। তবে জলবায়ু পরিবর্তন এবং জলসংকটও যে ক্রমশ যুদ্ধের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে ইরান-আফগান যুদ্ধ।
Powered by Froala Editor