গলির দেওয়ালই ক্যানভাস, স্কুলপড়ুয়াদের তুলিতে রঙিন হয়ে উঠছে বেহালা

“একটা বছর শেষ হতে চলল। আবার একটা বছর আসছে। নতুন বছরেও আগের বছরের নানা জড়তা থেকে যাবে মানুষের মধ্যে। আমরা যদি আমাদের ছবির মাধ্যমে সেই জড়তাগুলো কিছুটা হলেও ভেঙে দিতে পারি, তাহলে তার থেকে আনন্দের আর কিছুই হতে পারে না।” বলছিলেন সৌরভ ভট্টাচার্য। ডিসেম্বর মাসের ৪টি রবিবার ধরে বেহালার পুরনো ৪ তলা বিল্ডিং-এর গলিতে তিনি উপস্থিত হচ্ছেন। সঙ্গে থাকছে তাঁর ছাত্রছাত্রীরাও। তারা কেউই ১৮ বছরের গণ্ডি পেরোয়নি। আর এইসব কচিকাঁচাদের নিয়েই চলছে দেওয়ালের গায়ে ছবি আঁকার কাজ।

গতবছর বেহালাতেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল ‘বেহুলা’ নামের একটি পাবলিক আর্ট এগজিবিশন। সেখানে সনাতন ধিন্ধা, সুব্রত মান্নার মতো শিল্পীদের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন সৌরভ ভট্টাচার্যও। যদিও বাচ্চাদের সেখানে তুলি ধরতে দেওয়া হয়নি। প্রহরকে সৌরভবাবু জানালেন, সেদিনই তাঁর মনে হয়েছিল, যদি ছোটোদের নিয়েই এমন একটা কাজ করা যায়! আর দেখতে দেখতে সেই কাজ শুরু হয়ে গেল। “ওরা তো এমনিই সারাবছর পিঠে বোঝা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ছবি আঁকার মতো একটা বিষয়কে আর নতুন করে বোঝা নাই বা করে তুললাম! বরং আমি যদি কাগজের চারদিকে মার্জিন থেকে তাদের ক্যানভাসটা একটু বাড়িয়ে দিতে পারি, তাদের হাতের গ্রাফটা একটু বাড়িয়ে দিতে পারি, তাহলে ওরাও একটা আনন্দ খুঁজে পাবে। আর সত্যিই ওরা সেই আনন্দ খুঁজে পাচ্ছে।”

কর্মশালায় শামিল শিল্পী নবম শ্রেণীর শুভায়ন জানাল, “প্রকৃতিকে আমরা যেভাবে দেখি, সেই ভাবনাটাই এঁকে বোঝানোর চেষ্টা করছি। দূষণের মধ্যেও যে এখনও সৌন্দর্য দেখা যায়, সেটাই দেখাতে চাইছি আমরা।” যদিও সৌরভ ভট্টাচার্য বলছেন, “কোনো অ্যান্টি-পলিটিক্যাল বা অ্যান্টি-ইন্ট্যালেকচুয়াল প্রোপাগান্ডা না থাকলেও এই ছবির মধ্যে দিয়ে একধরনের সামাজিক বার্তা তুলে ধরার চেষ্টা আছে। সমাজের নানাকিছু দেখে যখন ভালো লাগে, যখন খারাপ লাগে; সেই সমস্ত অনুভূতি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। ছোটোরা হয়তো সবটা বুঝতে পারছে না। কিন্তু এই ছবিই যে কিছু বছর পর তাদের ভাবাবে না, সেটাই বা বলি কী করে?” দশম শ্রেণীর দিশানী জানাল, “এই প্রথম দেয়ালে চবি আঁকছি। আমাদের খাতার আঁকা তো সবাই দেখতে পায় না। এখানে সবাই এসে দেখে যাচ্ছে। খুব ভালো লাগছে।” সপ্তম শ্রেণীর পড়ুয়া দেবায়নও একইভাবে নিজের আনন্দ প্রকাশ করেছে। সে জানিয়েছে, “এরপর আরও অনেক দেওয়ালে ছবি আঁকতে চাই।”

বেহালার ‘অমরাবতী কলাক্ষেত্র’-এর শিক্ষক সৌরভ ভট্টাচার্য যেন ছবি আঁকা শেখার একটা নতুন ভাবনাই খুলে দিচ্ছেন। আর এই কাজে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন এলাকার মানুষরাও। তাঁরা নিজেদের বাড়ির দেওয়ালেই ছবি আঁকার অনুমতি দিয়েছেন। ৬ ফুট উঁচু দেয়াল প্রত্যেকটা। প্রায় ১২০ ফুট লম্বা গলির দুধারে সেজে উঠছে রঙিন ক্যানভাস। কোথাও দূষণে জীর্ণ কলকাতা শহরের মাথায় ডানা মেলেছে রঙিন প্রজাপতি। কোথাও আবার ঘূর্ণিঝড়ের পর ত্রাণের অপেক্ষায় থাকা মানুষকে দেখানো হয়েছে কাকের রূপকে। ‘তীর্থের কাক’, এই শব্দটাই যেন মনে আসে। রাস্তার ধারে ভোটের প্রচারের জন্য দলীয় প্রতীক দেখে তো আমরা সবাই অভ্যস্ত। আবারও একটা ভোটের মরশুম আসতে চলল। কিন্তু কলকাতা শহরেও পাবলিক আর্ট দেখা যাবে হাতে গোনা কয়েকটা দেওয়ালেই। আর সেই ছবি যদি কচিকাঁচাদের হাতেই রঙিন হয়ে ওঠে, তাহলে একটা বাড়তি মাত্রা তো যোগ হয়ে যায়ই।

আরও পড়ুন
কলকাতা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের প্রাণপুরুষ তিনি, বিস্মৃতির অতলে ডাঃ সুন্দরী মোহন দাস

Powered by Froala Editor

More From Author See More