‘যদি হাসিও অপরাধ হয়ে থাকে
তবে দেশের এখনও কিছু কাজ বাকি থেকে গেছে...’
স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে এভাবেই বারবার হুংকার ছেড়েছেন তিনি। কবিতার মধ্যে দিয়েই প্রতিবাদ গড়ে তুলতে চেয়েছেন স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে। তাঁর কথায়, তাঁর কবিতা ছিল সাধারণ মানুষের কান্না, আর্তনাদের বহিঃপ্রকাশ। বিশ্বাস ছিল সেই কবিতাই একদিন রাজনীতি, ধর্ম, অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর বাইরে গিয়ে স্পর্শ করবে মানুষকে।
কথা হচ্ছে সোমালি কবি মহম্মদ ইব্রাহিম বারসামে ওরফে হাদরাবিকে (Hadrawi) নিয়ে। সোমালিল্যান্ড (Somaliland)— সোমালিয়ার স্বঘোষিত স্বাধীন প্রজাতন্ত্র বিশ্বজুড়ে পরিচিত ‘ল্যান্ড অফ পোয়েট্রি’ বা কবিতার রাজ্য হিসাবে। সাধারণ মানুষের মুখে মুখে সেখানে শ্রুতির মতো উচ্চারিত হয় হাজার বছরের প্রাচীন কবিতা। সকলে কবিতা লিখতে না পারলেও, সোমালিল্যান্ডের অধিকাংশ মানুষই কবিতা শুনতে ও পড়তে ভালোবাসেন। এবার এই কবিতার দুনিয়াই হারাল তার কণ্ঠস্বর তথা অন্যতম কবি মহম্মদ ইব্রাহিম বারসামেকে। সম্প্রতি সোমালিল্যান্ডের রাজধানী হারগেইসায় ৭৯ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন আধুনিক সময়ের সবচেয়ে খ্যাতনামা সোমালি কবি।
চল্লিশের দশকের কথা। তখনও স্বাধীন হয়নি সোমালিয়া। একাংশে ব্রিটিশ রাজত্ব চলছে, অন্য অংশের ক্ষমতা দখল করেছে ইতালীয় ঔপনিবেশিক শাসকরা। ১৯৪৩ সালে সোমালিল্যান্ডের ব্রিটিশ অধ্যুষিত বুরাও-এ জন্ম হাদরাবির। বাবা ছিলেন সামান্য কৃষক। ৯ সন্তানের পেটের ভাত জোগাড় করতে রীতিমতো নাভিশ্বাস উঠত তাঁর। তাই ৯ বছর বয়সেই পরিবারের হাল ধরতে হয় হাদরাবিকে। কাকার সঙ্গে ইয়েমেনের এক বন্দরে পাড়ি দেন হাদরাবি। সেই বয়স থেকেই শিশুশ্রমিক হিসাবে লড়াই শুরু তাঁর। তবে পড়াশোনা থেমে থাকেনি। ইমেয়েনের এক স্কুলেই ভর্তি হন তিনি।
আরও পড়ুন
কবিতার সূত্রে শিল্পবৈচিত্রের মিলনসমাবেশ, সাক্ষী তিলোত্তমা
১৯৬০ সালে ঔপনিবেশিক শাসকদের হাত থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে সোমালিয়া। তার ঠিক পরেই ইয়েমেন থেকে মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন হাদরাবি। সোমালিয়ার রাজধানী মোগাদিশুর বেতার সংস্থায় কাজ শুরু করেন তিনি। তবে খুব বেশিদিন সেই কাজ করেননি। কৈশোরের যন্ত্রণাই হয়তো তাঁকে তাড়িত করেছিল পরবর্তীকালে শিক্ষকের পেশা বেছে নিতে। ১৯৬৩ সালে সোমালিল্যান্ডের এক প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন হাদরাবি। একইসঙ্গে চলত লাফুল বিশ্ববিদ্যালয়েও অধ্যয়নও। পরবর্তীতে এই বিশ্ববিদ্যালয়েই অধ্যাপনা করেছেন কিংবদন্তি কবি।
আরও পড়ুন
চেয়েছিলেন কবি হতে, গণিতের ‘নোবেল’ জিতলেন কোরিয়ান গণিতবিদ
ইয়েমেনে থাকাকালীন সময় থেকেই শুরু হয় তাঁর কবিতাযাপন। সঙ্গে নিজের কবিতায় সুর দিয়ে বহু গানও রচনা করেছেন হাদরাবি। সোমালিয়ার সামরিক শাসনের সময় এই কবিতাকেই তিনি বেছে নেন প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসাবে। মুখে মুখে সে-সময় ছড়িয়ে পড়েছিল তাঁর লেখা কবিতা। ফলস্বরূপ, ১৯৭৩ সালে তাঁকে গ্রেপ্তার করে সোমালিয়া প্রশাসন। দীর্ঘ ৬ বছর কারারুদ্ধ ছিলেন সোমালিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় কবি।
আরও পড়ুন
ভাষা থেকে ভাষাহীনতায় কবিতাযাত্রা, সাক্ষী রইল কলকাতা
১৯৭৮ সালে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর সোমালি রিপাবলিকের ‘অ্যাকাডেমি অফ আর্টস, সায়েন্স অ্যান্ড লিটারেচার’-এর ডিরেক্টর হিসাবে নিযুক্ত হন তিনি। সেই পদেও খুব বেশিদিন টিকে থাকতে পারেননি তিনি। সরকারের অবিচার, শোষণ এবং স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে ফের যুদ্ধে নামেন তিনি। ইস্যাক গণহত্যা নিয়েও সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সোমালিয়ার জাতীয় আন্দোলনে। হয়ে উঠেছিলেন সোমালিয়ার কণ্ঠস্বর।
অবশ্য ১৯৯১ সালে সোমালিল্যান্ড প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর নিজের জন্মভূমিতে ফেরেননি তিনি। বরং, বিশ্ব পরিদর্শনে পাড়ি দেন ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায়। একাধিক কবিতা উৎসব ও আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানেও তাঁকে দেখা গিয়েছিল নব্বই-এর দশকে। বলতে গেলে সোমালিয়া ও আফ্রিকার প্রতিনিধি হয়ে সেখানকার কবিতাকে তিনি পৌঁছে দিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক স্তরে।
১৯৯৯ সালে দেশে ফিরে সোমালিল্যান্ডের রাজধানী হারগেইসায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন হাদরাবি। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সেখানে থেকেই কবিতাচর্চা ও অধ্যাপনা করেছেন কিংবদন্তি সোমালি কবি। শুধু কবিতা কিংবা গানই নয়, একাধিক নাটকও রচনা করেছেন হাদরাবি। সোমালি ভাষার সংরক্ষণেও রয়েছে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান। কবিতা ও সাহিত্যে তাঁর অবদানের জন্য ভূষিত হয়েছেন ‘প্রিন্স ক্লউস’ সম্মাননায়। তবে দেশের সমস্ত মানুষকে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসাই ছিল তাঁর অন্যতম উদ্দেশ্য। সোমালিয়া থেকে সম্পূর্ণভাবে দুর্নীতির অবসান করতে না পারলেও, তাঁর সেই লড়াই যে সফল হয়েছিল, তারই প্রমাণ পাওয়া গেল তাঁর মৃত্যুর পর। সোমালিল্যান্ড তো বটেই, তাঁকে শেষ বিদায় জানাতে সোমালিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে এসেছিলেন অসংখ্য মানুষ। ইথিওপিয়া, কেনিয়া থেকেও হাজির হয়েছিলেন হাজার হাজার ভক্ত। স্কুলপড়ুয়া থেকে দিনমজুর, সরকারি কর্মী থেকে রাস্তার ভিক্ষুক— সেই ভিড়ে মিশে ছিল সকলেই। তাঁদের মধ্যে দিয়েই জীবিত থাকবেন হাদরাবি, তাতে সন্দেহ নেই কোনো…
Powered by Froala Editor