১৯৬১ সাল। ১২ এপ্রিল। জন্ম নিয়েছিল এক নতুন ইতিহাস। প্রথমবার মহাকাশে পৌঁছে গিয়েছিল মানুষ। নেপথ্যে ইউরি গ্যাগারিন। তবে মজার বিষয় হল, মহাকাশে পা রাখা প্রথম মানুষ হয়েও, দ্বিতীয়বার আর মহাকাশে যাওয়া হয়নি তাঁর। অবশ্য ১৯৬৭ সালে রাশিয়ার অন্য একটি স্পেস-মিশনের জন্য সম্ভাব্য নভোচারীদের তালিকায় নাম ছিল গ্যাগারিনের। তবে শেষ পর্যন্ত সে-যাত্রায় মহাকাশে পৌঁছেছিলেন তাঁরই বন্ধু ও সহকর্মী ভ্লাদিমির কোমারভ (Vladimir Komarov)। কিন্তু জীবিত অবস্থায় দেশে ফেরা হয়নি তাঁর।
ঠিকই ধরেছেন, এই গল্পের নায়ক গ্যাগারিন নন, বরং কোমারভ। মর্মান্তিক পরিণতি জেনেও যিনি ঝুঁকি নিয়েছিলেন মহাকাশযাত্রার। শুধুমাত্র গ্যাগারিনকে বাঁচাতে।
শুরু থেকেই বলা যাক এই গল্প। ১৯৬৭ সাল। সেবার ৫০ বছরে পা দিয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্পেস প্রোগ্রাম। আর এই মাইলস্টোন স্পর্শ করার ব্যাপারটাকে উদযাপন করতেই এক আশ্চর্য পরিকল্পনা করে সোভিয়েত স্পেস প্রোগ্রাম। কী সেই পরিকল্পনা। ঠিক হয়, রাশিয়ার বুক থেকে প্রথমে উড়ান নেবে সোয়াজ-১ নামের একটি মহাকাশযান। ঠিক তার একদিন পর মহাকাশে পাড়ি দেবে তারই যমজ মহাকাশযান সোয়াজ-২। মহাশূন্যে গিয়ে দুই মহাকাশচারী এক স্পেসশিপ থেকে বেরিয়ে স্পেস ওয়াক করে প্রবেশ করবেন অন্যটিকে।
বলাই বাহুল্য, এহেন কৃতিত্ব তখনও পর্যন্ত করে দেখাতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র। কাজেই ঠান্ডাযুদ্ধের প্রেক্ষিতে তা এগিয়ে দেবে সোভিয়েতকে, তাতে আর আশ্চর্যের কী। প্রাথমিকভাবে এই মিশনের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল ১২ জন মহাকাশচারীকে। তাদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছিল বিস্তর। ছিল কঠোর অনুশীলন এবং পরীক্ষা দেওয়ার বন্দোবস্ত। সেই তালিকাতেই জায়গা পেয়েছিলেন কোমারভ। ছিলেন গ্যাগারিনও।
মূল ঘটনায় যাওয়ার আগে, কোমারভের ব্যাপারে একটু বলে নেওয়া যাক। ১৯২৭ সালে মস্কোয় জন্ম কোমারভের। কৈশোর থেকেই তাঁকে আকৃষ্ট করত বিমান এবং অ্যারোনটিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং। তবে শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞান ছেড়ে সৈনিকের জীবনকেই বেছে নেন তিনি। কেন-না সে-সময় যুদ্ধ চলছে দেশে। নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে লড়ছে সোভিয়েত। কতদিন চলবে এই যুদ্ধ, জানা নেই কারোরই।
১৯৪৩ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে মস্কো স্পেশাল এয়ারফোর্স স্কুলে ভর্তি হন কোমারভ। ৩ বছরের প্রশিক্ষণের পর স্নাতক ডিগ্রিলাভ। তারপর লেফটেন্যান্ট পদ নিয়ে সোভিয়েতের বিমান বাহিনীতে যোগদান। তবে ততদিনে শেষ হয়ে গেছে বিশ্বযুদ্ধ। যুদ্ধের ময়দানে সরাসরি লড়াই করার ইচ্ছে পূরণ হয় আর কোনোদিনই। টানা ৫ বছর সোভিয়েত বাহিনীতে কাজ করার পর আবার তিনি ফিরে যান বিজ্ঞানের কাছে। যোগ দেন সেন্ট্রাল সায়েন্টিফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটে। মহাকাশ গবেষণা ও সোভিয়েত স্পেস প্রোগ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া সেই সূত্রেই।
যাই হোক, এবার ফেরা যাক মূল কাহিনিতে। কথা ছিল ১৯৬৭ সালের ২৩ এপ্রিল মহাকাশে পাড়ি দেবে সোয়াজ-১। প্রস্তুতিও চলছিল পুরোদমে। তবে বিপত্তি বাঁধে এই অভিযানের মাস খানেক আগে। উৎক্ষেপণের ঠিক এক মাস আগেই ধরা পড়ে সংশ্লিষ্ট মহাকাশযানটিতে রয়েছে ২০০টিরও বেশ প্রযুক্তিগত সমস্যা। আর যার পরিণাম নিশ্চিতভাবে পাইলটের মৃত্যু।
ত্রুটিগুলিকে লিপিবদ্ধ করে ১০ পাতার একটি বিশেষ মেমোও তৈরি করেছিলেন সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি লিওনিড ব্রেজনেভের হাতে এই রিপোর্ট তুলে দেওয়ার সাহস ছিল না কারোরই। বলতে গেলে, এমন ‘অপরাধমূলক’ কাজ এককথায় যেন আত্মহত্যারই সমান। এমন পদক্ষেপ নিলে প্রশাসনের নজরবন্দি হয়ে থাকবে হবে আজীবন।
উল্লেখ্য, কেজিবির অভ্যন্তরে চেনাশোনা থাকায় সংশ্লিষ্ট ব্যাপারটা জানতে পেরেছিলেন ইউরি গ্যাগারিন। এমনকি সেটা নিয়ে তিনি সরব হওয়ারও চেষ্টা করেছিলেন। যদিও শেষ পর্যন্ত সোভিয়েত স্পেস প্রোগ্রামের কর্মকর্তারা তাঁকে ‘নিষিদ্ধ’ করেছিল এই অপরাধের জন্য। তবে গ্যাগারিন পিছিয়ে আসেননি। বরং, সরাসরি আটকানোর চেষ্টা করেন কোমারভকে। অবশ্য সে-কথা শোনার পাত্র ছিলেন না তিনি। মৃত্যু অবধারিত জেনেও মহাকাশে পাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন কোমারভ। আর তার কারণ হল, তিনি না যেতে চাইলে নিশ্চিতভাবেই এই স্পেস প্রোগ্রামে বলি দেওয়া হত তাঁরই বন্ধু তথা বিশ্বের প্রথম নভোচর ইউরি গ্যাগারিনকে। বদলে, এই ‘আশ্চর্য মৃত্যু’-র সুযোগটাকেই তিনি ব্যবহার করেন হাতিয়ার হিসাবে।
সোভিয়েতের অভ্যন্তরীণ জালিয়াতি, একনায়কতান্ত্রিক চরিত্রকে সামনে আনার জন্য, মহাকাশযাত্রার আগেই তিনি জানিয়েছিলেন, যদি এই যাত্রায় দুর্ঘটনাবশত যদি তাঁর মৃত্যু হয়, তবে যথাযথ সম্মানের সঙ্গে যেন শেষকৃত্য করা হয় তাঁর। তার কারণ, এই মিশন যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ। যে-কথা উল্লেখিত রয়েছে ইউরি গ্যাগারিনের আত্মকথাতেও। মজার বিষয় হল, এই অভিযানের আগে উৎক্ষেপণকেন্দ্রে কোমারভকে শেষ বিদায় জানাতে গিয়েছিলেন গ্যাগারিন। চেয়েছিল সময় নষ্ট করতে। যাতে শেষ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায় মহাকাশযানের উৎক্ষেপণ। তবে বৃথা যায় সেই চেষ্টা।
ঠিক তার পরদিনই মর্মান্তিক পরিণতি ঘটে কোমারভের। মহাকাশে যাওয়ার পরই দেখা দেয় কন্ট্রোল ইউনিট, ম্যানুভার ইউনিট, কমিউনিকেশন এবং সোলার পাওয়ার-সহ একাধিক সমস্যা। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ক্রমশ পৃথিবীর বুকে খসে পড়তে থাকে সোয়াজ-১। এমনকি বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের পর খোলেনি মূল মডিউলের প্যারাসুটও। ফলে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে ক্রমবর্ধমান বেগে পৃথিবীতে আছড়ে পড়েন কোমারভ। বিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে বলে ফ্রি ফল। উল্লেখ্য, মহাকাশ থেকে খসে পড়া পৃথিবীর প্রথম এবং শেষ মানুষ কোমারভই। কোমারভের মর্মান্তিক মৃত্যুতে বাতিল করে দেওয়া হয় সোয়াজ-২ মিশনটিও। পরবর্তীতে তাঁর কথা অনুযায়ীই, মস্কোতে আয়োজিত হয়েছিল বিশেষ শোকসভা। এমনকি পরবর্তীতে চাঁদে পৌঁছে তাঁকে বিশেষ শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নভোচররাও…
Powered by Froala Editor