অষ্টমীর সকাল। যতই করোনা চেপে ধরুক, অঞ্জলি দেওয়া চাইই চাই। আর সেই সঙ্গে চোখ থাকবে টিভি’র পর্দায়। সশরীরে না হোক, দূর থেকেই কুমারী পুজো চাক্ষুষ দেখা যাবে। আর কুমারী পুজো বললেই সবার আগে ভেসে আসবে বেলুড় মঠের নাম। থিম ও আধুনিকতার পাশে দাঁড়িয়ে এখনও একইরকমভাবে নিয়ম নিষ্ঠা মেনে দেবী দুর্গার আরাধনা করে আসছে এই মঠ। যার সঙ্গে জুড়ে আছে বাংলার সনাতন ঐতিহ্য; জড়িয়ে আছেন স্বামী বিবেকানন্দ…
বেলুড় মঠের দুর্গাপুজোর ইতিহাস হয়ত কমবেশি সবারই জানা। তখন সদ্য শুরু হয়েছে মঠের যাত্রাপথ। সবার ওপরে রয়েছেন স্বামী বিবেকানন্দ। সমস্ত দিক দেখাশোনা করছেন তিনি। ঠাকুরের ছায়া যেন সবসময় রয়েছে এই মঠের ওপর। একদিন নিজের ঘরের সামনের বেলগাছের তলায় বসেছিলেন স্বামীজি। নানা কথা ভাবতে ভাবতে, হঠাৎই মনে পড়ে দুর্গাপূজার কথা। কলকাতায় কত দেখেছেন মাতৃমূর্তির আরাধনা। আচ্ছা, যদি বেলুড় মঠেও দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়? যেমন ভাবা, তেমনই কাজ। ১৯০১ সাল। বেলুড় মঠের বুকে তৈরি হল ইতিহাস। প্রথমবার দুর্গাপূজার সূচনা করলেন স্বামীজি। তার আগে পঞ্চমীর দিন কুমোরটুলি থেকে প্রতিমা নিয়ে এসেছিলেন কৃষ্ণলাল মহারাজ। ঠিক হল, প্রাচীন বৈদিক মতে পুজো করা হবে বলে। স্বামীজির সঙ্গে তাঁর শিষ্যরাও যুক্ত হন পুজোর কাজে। আর পূজারীর আসনে বসেন ব্রহ্মচারী কৃষ্ণলাল…
সবই তো হল, কিন্তু পুজো শুরুর আগে কপালে পড়ল ভাঁজ। নিয়ম অনুযায়ী, একজনের নামে সংকল্প করে দুর্গাপুজো শুরু হয়। কিন্তু সংকল্প করা হবে কার নামে? সন্ন্যাসীরা তো পুজোর সংকল্প নিতে পারবেন না! তাহলে এখন উপায়? শেষমেশ এখানেও রক্ষাকর্তা হয়ে উঠে এলেন স্বামী বিবেকানন্দ। তিনিই বলে দেন উপায়। মঠের সবকিছুই তো ঠাকুরের জন্য। তিনি তো আর নেই; কিন্তু সারদা দেবী তো জীবিত আছেন! তিনি তো সকলের মা! তাঁর নামে দুর্গাপুজোর সংকল্প কি করা যায় না? খবর গেল সারদা দেবীর কাছে। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যান তিনি। হাওড়ার ঘুসুরি থেকে বেলুড়ে নিয়ে আসা হয় তাঁকে। স্বামীজি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলেন মায়ের দিকে। ইনিও তো মা! সবার মা! জ্যান্ত দুর্গা! শেষমেশ, অষ্টমীর দিন নিজের হাতে, ১০৮টি পদ্মফুল দিয়ে সারদা দেবীকে ‘জ্যান্ত দুর্গা’ রূপে পুজো করেন স্বামী বিবেকানন্দ…
বেলুড় মঠের পুজোর কথা বললেই আমদের সামনে ভেসে উঠবে কুমারী পূজার দৃশ্য। দুর্গা আরাধনার এই বিশেষ পর্বটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এবং পবিত্র। যে সমস্ত জায়গায় অষ্টমীর দিন এই বিশেষ পূজার আয়োজন করা হয়, সেখানকার পরিবেশই বদলে যায় এক মুহূর্তে। বেলুড় মঠে কুমারী পুজোকেই এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন স্বামীজি। ১৯০১ সালে মঠেরই প্রিয় রামলালদাদার মেয়েকে কুমারীর আসনে বসানো হয়। স্বয়ং সারদামণি দেবীর সামনেই নিজের হাতে সেই কুমারীর পুজো করেন স্বামী বিবেকানন্দ। সেই যে শুরু হয়েছিল প্রথা, আজও সমান নিষ্ঠার সঙ্গে, সমান গুরুত্ব দিয়ে এই পূজা চলে আসছে।
ঐতিহ্য, ইতিহাস, ভক্তি আর বিশ্বাস— এই সবকিছুর সংমিশ্রণ তৈরি হয় বেলুড় মঠের পুজোয়। এই পুজোর হাত ধরেই পরবর্তীকালে রাজ্যের অন্যান্য রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠেও কুমারী পূজার প্রচলন হয়। এই বছর হয়তো সামনে থেকে সাক্ষী থাকতে পারবেন না সেই মুহূর্তের। কিন্তু টিভির পর্দায় বসলে প্রতিবারের মতো এবারও সরাসরি সম্প্রচার হবে অষ্টমী তিথির বিশেষ পুজোর। প্রতিটা মন্ত্রোচ্চারণে শুদ্ধ হবে আবহাওয়া। হয়ত এভাবেই পরশ পাবেন সেই মুহূর্তের। সঙ্গে একটাই প্রার্থনা, সবাই যেন সুস্থ থাকে। ভালো থাকে। দুর্যোগ যেন কেটে যায়…
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
অসুরপূজা নিয়ে ঘোর বিতর্ক; দুর্গা-মহিষ দ্বন্দ্ব সম্পর্কে কী কী বলে আবহমান সংস্কৃতি?