‘…অনেকদিন গালিব না করে মাছ ধরতে বসে মাছ মেলেনি। তখন ধোঁকা দেবার চেষ্টা করেছি, আজ তোমার ওপর অনেক কাজ করবো, মাছ দাও গালিব। মাছ দেয়নি। আমাদের থেকে অনেকানেক ধুরন্ধর সে, মানে গালিব।’
লিখছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। মির্জা গালিবের কবিতা অনুবাদ করতে গিয়ে, এমনই উপলব্ধি তাঁর। এও বলেছেন, গালিবকে বাংলায় ধরতে চাওয়া কত কঠিন। সত্যিই তো! সারাজীবন প্রেমে-অপ্রেমে কাটালেন যিনি, ফুর্তিতে ও দুঃখে, তাঁকে তাঁর ভাষা থেকে অন্য ভাষায় বুঝতে চাওয়া কি এতই সহজ! প্রথমে ফার্সি ও তারপর উর্দু – গালিবের লেখা শায়েরি কম নয়। হারিয়েও গিয়েছে অনেক। কিন্তু তাও যা আছে, কবিতাপ্রেমীকে আচ্ছন্ন করার পক্ষে যথেষ্ট।
কিন্তু এই আচ্ছন্নতার পিছনে ব্যক্তি গালিব ঠিক কেমন? ফুর্তিবাজ, মৌজে থাকা লোকটির ভেতরে পাল্লা দিয়ে পাক খাচ্ছে বিষণ্ণতা। মৃত্যুচিন্তা ও অনটন। শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের সভাকবি ছিলেন তিনি। ১৮৫৭ সালে সে-পাট চুকলে, আর্থিক সমস্যা আরও চেপে ধরে তাঁকে। অবশ্য কোনদিনই বা ছিল না! বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নবাব বা মুনসিদের থেকে ভাতা নিয়েছেন। ব্রিটিশ সরকারের কাছে আবেদনও করেছেন মাসিক ভাতা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর। এমনকি, অনুজদের কাছে সরাসরি টাকা চাইতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি তিনি, বৃদ্ধ বয়সে। মনে পড়ে জীবনানন্দ দাশকে। আর্থিক অনটন পর্যুদস্ত করেছিল তাঁকেও। টাকার জন্য কবিতা-গল্প দিতে চেয়েছেন আগ বাড়িয়ে। পরিচিতদের অনুরোধ করেছেন চাকরি জোগাড় করে দিতে। জীবনানন্দের প্রায় ৮০ বছর আগে, দিল্লিতে গালিবের অবস্থাও আলাদা ছিল না খুব একটা।
কিন্তু পরিস্থিতির ফারাকও ছিল অনেক। জীবদ্দশায় এবং পরবর্তীকালেও জীবনানন্দ ‘জনসাধারণের কবি’ হয়ে উঠতে পারেননি। কিন্তু গালিব আক্ষরিক অর্থেই জনসাধারণের কবি ছিলেন। এবং নাগরিক কবি। তবুও অর্থচিন্তা ও দুর্দশা তাঁকে ছেড়ে যায়নি। কারণ কী? আপাত-অভিজাত জীবনযাপন? মদ্যপানের আসক্তি? কে জানে!
সিপাহী বিদ্রোহের সময়, কয়েকজন ব্রিটিশ সৈন্য তাঁকে ধরে নিয়ে যায় কর্নেল ব্রাউনের কাছে। কর্নেল জিজ্ঞেস করেন গালিবকে, তিনি মুসলমান কিনা। গালিবের জবাব ছিল – ‘জি, আধা। মদ খাই, শুয়োর খাই না।’ বিভিন্নক্ষেত্রে সমালোচিত হওয়া সত্ত্বেও, গালিব মদ্যপান ছাড়েননি। কে জানে, নেশাগ্রস্ত দশাই হয়তো ছিল তাঁর কাব্যের মূল উৎস। গালিবকে একবার একজন বলেছিলেন, যারা মদ খায়, আল্লাহ তাদের প্রার্থনা শোনেন না। গালিব উত্তর দিয়েছিলেন – ‘ভাই, যার মদ আছে সে আবার কীসের জন্য প্রার্থনা করবে?’
তাঁর দর্শন ছিল জীবনটা আনন্দে কাটানোর। বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে নয়। অথচ ভাগ্য ও পরিস্থিতি তাঁকে বারবার টেনে নিয়ে গেছে সেই দশায়। সাত সন্তানের কেউই বাঁচেনি বেশিদিন। ভাইপোকে দত্তক নেওয়ার পর, সেও মারা যায় কমবয়সেই। শেষ বয়সে নিজেও হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন, মৃত্যুর কাছে সবাই অসহায়। রুগ্ন বৃদ্ধ গালিবকে লোহারুর নবাব চিঠি লিখে জানতে চেয়েছিলেন, কেমন আছেন গালিব। কবির উত্তর ছিল – ‘দু’একদিনের মধ্যে আমার পাড়াপড়শিকে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবে, গালিব কেমন আছে।’
আরও পড়ুন
পূর্ণতা পায়নি প্রেম, পার্ক স্ট্রিটের গোরস্থানে খোদিত রইল এক কবির বিরহব্যথা
যৌবনে কলকাতাতেও এসেছিলেন তিনি। ১৮২৮ সালে। কারণ ছিল ব্রিটিশ সরকারের কাছে বন্ধ হয়ে যাওয়া মাসিক ভাতা পুনরায় চালু করার দাবি জানানো। প্রায় দেড় বছর কলকাতায় ছিলেন গালিব। ‘সফর-এ-কলকাত্তাহ্’-তে লিখছেন, শিমলা বাজারের কাছে ১৩৩ নং হাভেলিতে থাকতেন তিনি। যার বর্তমান ঠিকানা রামদুলাল সরকার স্ট্রিটে। কলকাতায় থাকাকালীন, এক কবিসভায় অন্যান্য শায়েরদের সঙ্গে বিতর্কেও জড়িয়ে পড়েছিলেন একটি শায়েরির ব্যকরণগত প্রয়োগ নিয়ে। সর্বোপরি, যে-উদ্দেশ্য নিয়ে কলকাতায় এসেছিলেন, তা সিদ্ধ হয়নি। তবু কলকাতার সুখ্যাতিই করেছেন। লিখেছিলেন –
‘কলকাত্তেকা জো জিক্র কিয়া তুনে হম নশীঁ
এক তীর মেরে সীনে মে মারা কে হায় হায়।’
তবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে যা থেকে যায়, তা হল ভাবনা। পঁয়ষট্টি বছর বয়সে, বন্ধু মির্জা হাতিম আলি মেহের’কে গালিব লিখছেন – ‘মিছরির মাছি হয়ে যাও, মধুর মাছি হয়ো না।’ আর, প্রায় দু’দশক পর, দক্ষিণেশ্বরে বসে এক ‘পাগল’ কালীসাধক শিষ্যদের বলছেন পাঁকাল মাছের মতো হতে। সংসারে থেকেও পিছলে যাওয়ার কথা। বলছেন পরমহংস হতে। জল ফেলে রেখে, দুধটুকু খেতে শুধু। আবার, একশো বছর পিছিয়ে গেলে, আরেক বাঙালি সাধক তাঁর গানে লিখে রাখছেন – ‘খাব খাব বলি মাগো, উদরস্থ না করিব।’ দর্শনের এই স্তরে এসে রামপ্রসাদ-গালিব-রামকৃষ্ণ এক হয়ে যান। গালিবের লেখার সঙ্গে রামকৃষ্ণ যে পরিচিত ছিলেন না, তা বলাই বাহুল্য। অন্যদিকে, রামপ্রসাদ বা রামকৃষ্ণের যাপনের সঙ্গে গালিবের কতই না ফারাক! গালিব তো ভোগবাদী, তবুও জানেন মিছরির মাছি হয়ে শুধু মিষ্টত্বটুকু চেখে নিতে। মধুর আঠায় না জড়িয়ে পড়তে। এই যে গ্রহণ-বর্জনের পালা, দূরত্বে থেকে সরটুকু চেখে নেওয়ার পরিমিতিবোধ, গালিবের আয়ত্তে ছিল তা। নইলে কীভাবেই বা লিখবেন তিনি –
আরও পড়ুন
সংসারে অর্থকষ্ট, জন্মদিনে মেয়েকে কবিতা উপহার দিলেন বুদ্ধদেব বসু
‘দিল আপ্কা কে দিল্মেঁ হ্যায়ঁ জো কুছ সো আপকা
দিল লিজিয়ে মগর মেরে আরমাঁ নিকাল্কে।’
প্রবল ভোগবাসনার মধ্যে, জাগতিক বেঁচে থাকার মধ্যেও এই উদাসীনতার নামই গালিব। প্রেমে হোক, বা জীবনে…
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
পাকিস্তান আর আরবে দুর্গাপুজো, উর্দুতে লেখা চণ্ডীমন্ত্র