কেউ চোখের জলে বিদায় জানিয়ে এসেছেন প্রতিবেশীদের। কেউ আবার দাঙ্গার আগুনে জ্বলতে থাকা গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে বেঁচেছেন। তখন প্রত্যেকেরই বয়স কম। কিন্তু ফেলে আসা গ্রামের কিছু ছবি আজও মনের মধ্যে ছাপা হয়ে আছে। এখন আর সেখানে ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। দুই দেশের মাঝখানে কাঁটাতারের সীমানা। সেই সীমানা পেরোলেই উর্দি পরা হাত এগিয়ে এসে পাসপোর্ট চাইবে। আর পাসপোর্ট নিয়ে হাজির হলেও তো সেখানে যেতে হবে বিদেশির মতো। ১৯৪৭ সালের দেশভাগে ভিটেমাটি হারানো সেই মানুষদের শৈশবের স্মৃতিতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে অভিনব উদ্যোগ নিলেন প্রোজেক্ট দাসতানের কর্মীরা। আর এই উদ্যোগে হাতিয়ার ভার্চুয়াল রিয়েলিটি টেকনোলজি।
দেশভাগের সময় ভিটেমাটি হারানো মানুষদের ফেলে আসা গ্রামগুলোয় গিয়ে ভিডিও রেকর্ড তৈরি করেছেন প্রোজেক্ট দাসতানের কর্মীরা। তারপর সেই রেকর্ড এডিট করা হয়েছে ভিআর প্রযুক্তির মতো করে। সীমান্তের ওপারে থাকা মানুষটির চোখে একটি বিশেষ চশমা পরিয়ে দিলেই তিনি স্পষ্ট দেখতে পাবেন সব। তাঁর ফেলে আসা গ্রাম আজ কেমন আছে! পাকিস্তানে বসে এমনই এক মহিলা অবাক হয়ে গিয়েছিলেন পাঞ্জাবে তাঁদের গ্রামের মসজিদটি দেখে। গ্রামের আর কিছুই বিশেষ চিনতে পারেননি তিনি। কিন্তু মসজিদটি দেখে চমকে উঠেছিলেন। ভেবেছিলেন, হয়তো দাঙ্গায় নষ্ট হয়ে গিয়েছে সেই মসজিদ। অথচ আজকের ছবি বলছে সেই দরবার ঘরের কোথাও একটা আঁচড় পড়েনি। এমনকি শিখ সম্প্রদায়ের মানুষরা নিজেরা মসজিদকে আগলে রেখেছেন, প্রতি বছর বিশেষ বিশেষ পরবে উৎসবের আয়োজনও করেন। তবে সবার কাহিনি একরকম নয়। কেউ কেউ হয়তো খুঁজে পেয়েছেন একটু পুকুর বা একটি পোড়ো মন্দির। আবার কারোর শৈশবের প্রায় সব স্মৃতিই হারিয়ে গিয়েছে এতদিনে। তবু তো সেখানেই ফেলে এসেছেন জীবনের মূল। এতদিন পর সেই স্মৃতিতে ফিরে যাওয়াই এক বাড়তি পাওনা।
২০১৮ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির দুই গবেষকের আলোচনা থেকে শুরু প্রোজেক্ট দাসতানের পথচলা। দিল্লি নিবাসী স্পর্শ আহুজা এবং লাহোরের আমিনা মালকের কফির আড্ডায় উঠে এসেছিল তাঁদের দাদু-ঠাকুমার কাছে শোনা গল্পগুলো। দুই পরিবারই ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় কাঁটাতার পেরিয়ে ছিল দুই বিপরীত পথে। সেইসব গল্পের মধ্যে মিল যেমন আছে, তেমনই আছে বৈচিত্রও। সেইসমস্ত বৈচিত্রকেই খুঁজতে চেয়েছে প্রোজেক্ট দাসতান। স্পর্শ আহুজার মতে, আসলে দেশভাগের সমষ্টিগত গল্পের মধ্যে থাকা বৈচিত্রকেই ক্রমশ বাদ দিয়ে ফেলা হচ্ছে রাজনৈতিকভাবে। দেশভাগের আগে সবকিছু খুব সুন্দর ছিল, এমনটা বলেন সকলেই। কিন্তু এর পরেই এসে যায়, দেশভাগের সময় ভিন্ন ধর্মের মানুষের হাত থেকে পালিয়ে বেঁচেছেন তাঁরা। অথচ এর মাঝে একটি কথা হারিয়ে যায়, পরিকল্পিত সেই দাঙ্গা পরিস্থিতির আগে দুই সম্প্রদায়ের সম্পর্কও খুব সুন্দর ছিল। শুধু তাই নয়, এখনও সেই সম্প্রীতির পরিবেশ গড়ে তোলা যায়, বা গড়ে উঠেছেও। তিনটি দেশের রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের স্বার্থে মানুষের সেই স্মৃতিকে ভুলিয়ে দিতে চাইছেন। গড়ে তুলছেন একটা একমুখী জাতীয়তাবাদ। দেশভাগের প্রকৃত ইতিহাস উদ্ধার করা গেলে আসলে সেই রাজনীতিকেই হারিয়ে দেওয়া যাবে বলে বিশ্বাসী প্রোজেক্ট দাসতানের কর্মীরা। ২০২২ সালে দেশভাগের ৭৫ বছরকে সামনে রেখে ৭৫ জন দেশান্তরিত মানুষের সাক্ষাৎকার নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে শুরু হয়েছিল প্রোজেক্ট দাসতান। তবে করোনা পরিস্থিতিতে সেই প্রক্রিয়া কিছুটা ব্যাহত হয়েছে। ইতিমধ্যে অবশ্য ৩০ জনের বেশি মানুষের সাক্ষাৎকার নিতে পেরেছেন তাঁরা। ইতিহাস সংরক্ষণের পাশাপাশি মানুষকে তাঁর হারিয়ে যাওয়া শৈশবে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া এক সামাজিক দায়বদ্ধতাও বটে।
Powered by Froala Editor