সামনে বসে রয়েছেন উস্তাদ আলি আকবর খান। পাঠ দিচ্ছেন সুরের। আর তাঁর কথার মধ্যে দিয়েই খুলে যাচ্ছে সুরের বিভিন্ন গোপন জাদুপথ। শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেউ সরোদবাদক, আবার সেতার কিংবা অন্য কোনো যন্ত্রও বাজান কেউ কেউ। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন এক তরুণীও। হাতে বেহালা। তবে মনের মধ্যে ক্রমশ দ্বন্দ্ব চলছে একটা। সরোদ কিংবা সেতারে অনুরণন তৈরির জন্য রয়েছে উপরের দিকে কম্পাঙ্কের একটি তার। কিন্তু এই সুযোগ বেহালায় কোথায়? তবে কি তিনি সঙ্গীতমাধুর্য ফুটিয়ে তুলতে পারবেন না তাঁর অভিপ্রেত বাদ্যযন্ত্রে?
তার সমাধান হিসাবেই নিজের যন্ত্রকে খানিকটা বদলে নিলেন তিনি। চারটি তারের জায়গায় স্থান পেল পাঁচটি তার। আর তাতে যেন খেলে গেল জাদু। সুরকে আরও ভারী বেদনার করে তুলল পঞ্চম তারটি। রঙিন করে তোলে গমক আর মীড়ের সংমিশ্রণকে। উস্তাদ আলি আকবর খানের সেদিনের সেই ছাত্রী আর কেউ নন, বেহালাবাদক শিশিরকণা ধর চৌধুরী। গতকাল চলে গেলেন তিনি। বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। শেষ হল ‘বাবা আলাউদ্দিন ঘরানা’-র একটি অধ্যায়।
১৯৩৭ সালে অসমের শিলং-এ জন্ম শিশিরকণা ধর চৌধুরীর। বাবা ছিলেন অত্যন্ত সঙ্গীতপ্রিয় একজন মানুষ। নিজে সঙ্গীতের পাঠ না নিলেও চাইতেন সন্তান যেন জীবনের অঙ্গ করে নেয় সুরকে। আর সেই লক্ষ্যেই শিলং-এর সঙ্গীতশিল্পী ওস্তাদ মোতি মিয়াঁর করা তালিম নিতে পাঠান কন্যাকে। পরবর্তীকালে পণ্ডিত ভি. জি. যোগ এবং আলি আকবর খানের কাছেও সঙ্গীতের পাঠ নিয়েছেন শিশিরকণা। তবে শুধু ভায়োলিনই নয়, সমান দক্ষতার সঙ্গে তিনি বাজাতেন ভায়োলাও। পাশাপাশি আয়ত্তে ছিল কণ্ঠসঙ্গীতও।
১৯৫৪ সাল। বয়স তখন মাত্র ১৭ বছর। তানসেন-বিষ্ণু দিগম্বর সর্বভারতীয় সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় বিচারক ও শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে দিল তাঁর সঙ্গীত-উপস্থাপনা। সেই প্রতিযোগিতায় শুধু স্বর্ণপদকই পাননি তিনি, ছিনিয়ে নিয়েছিলেন বিষ্ণু দিগম্বর পুরস্কারও। সারা ভারত সেই প্রথম চিনেছিল সঙ্গীতের প্রোডিজিকে। বাকিটা ইতিহাস।
আরও পড়ুন
ভ্রাম্যমাণ ট্রাকেই সঙ্গীত পরিবেশন ভেনেজুয়েলার শিল্পীর
বেহালা মূলত পাশ্চাত্যের বাদ্যযন্ত্র। তবে তাতে যে ভারতীয় রাগসঙ্গীত এতটুকু কম শোভা পায় না, তাই-ই দেখিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। বিশেষ করে তাঁর বাদনে অন্য মাত্রা পেয়েছিল ধ্রুপদ। গায়কির ধাঁচে অন্য মাত্রা পেয়েছিল রাগ মারু বিহাগ, কৌশী ভৈরবী কিংবা দরবারি কন্নড়ি। আকাশবাণী এবং দূরদর্শনে ধারাবাহিকভাবেই সঙ্গীত উপস্থাপনা করেছেন। সঙ্গ দিয়েছিলেন শঙ্কর ঘোষ, মহাপুরুষ মিশ্র, জাকির হোসেন, স্বপন চৌধুরী প্রমুখ সঙ্গীতনক্ষত্রকে।
তবে জন্ম শিলং-এ হলেও জীবনের একটা বড়ো অধ্যায় কলকাতাতেই কাটিয়েছেন তিনি। ১৯৭১ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে সঙ্গীতের অধ্যাপিকা হিসাবে দায়িত্ব নেন শিশিরকণা ধর চৌধুরী। তারপর প্রায় দুই দশক কেটে গেছে এই শহরেই। বাবা আলাউদ্দিন ঘরানার আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন তিনি।
আরও পড়ুন
অবসাদ কাটিয়ে স্বাভাবিক জীবনে সঙ্গীতশিল্পী জেমস আর্থার, জানালেন অভিজ্ঞতা
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে কলকাতা ছেড়ে তিনি ঠিকানা বদল করেন ক্যালিফোর্নিয়ায়। বাকি জীবন কাটিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের আলি আকবর খান সঙ্গীত প্রতিষ্ঠানে। শিক্ষাকতার পাশাপাশি সামলেছেন ফাইন-আর্টস বিভাগের উপাচার্যের পদও।
ঝুলিতে রয়েছে একাধিক পুরস্কার। যার মধ্যে অন্যতম ১৯৯৭ সালে পাওয়া সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি সম্মান। পেয়েছেন ‘সঙ্গীত সম্মান’ পুরস্কারও। তবে তাঁর চলে যাওয়ার সঙ্গে যেন মিশে থাকল অদ্ভুত এক নীরবতা। তাঁকে কতটা মনে রাখতে পারল বাঙালি তথা ভারতীয় সঙ্গীতপ্রেমীরা? এই প্রশ্নই ঘুরে ফিরে আসবে বারবার…
আরও পড়ুন
প্রয়াত ‘দ্য ওয়েলারস’-এর শেষ সদস্য বানি ওয়েলার, শেষ হল রেজি সঙ্গীতের একটি অধ্যায়
ঋণস্বীকার - সন্দীপন গঙ্গোপাধ্যায়, ধ্রুবজ্যোতি গঙ্গোপাধ্যায়
Powered by Froala Editor