শব্দযুদ্ধে জেরবার দুই কোরিয়ার সীমান্তে থাকা গ্রামবাসীদের জীবন

দু-দেশের যুদ্ধ শেষ হয়েছে প্রায় সত্তর বছর হয়ে গেল। বিবাদ ঘুচে যাওয়ার বদলে, দূরত্ব বেড়ে গেছে আরো। সীমান্তে বেড়েছে সেনার সংখ্যা, কড়া হয়েছে নজরদারি। যত সময় গড়িয়েছে, তত যেন উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে সমস্যা বেড়েছে বই কমেনি। ১৯৫৩ সালে দুই দেশ পাকাপাকিভাবে বিভক্ত হয়ে গেলেও তাদের মাঝখানে পড়ে গেছে দুটি গ্রাম। চারদিকের কাঁটাতারের বেড়ার মধ্যে অদ্ভুতভাবে দিন কাটাতে হচ্ছে গ্রামবাসীদের। বা বলা ভালো, একটি গ্রামের বাসিন্দাদের।

উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার সীমান্ত প্রায় ২০০ কিলোমিটার বিস্তৃত। তার মধ্যে মাত্র চার কিমি জায়গা ছেড়ে রাখা হয়েছে ‘শান্তির প্রতীক’ হিসেবে। এখানে কোনো সেনাবাহিনীর টহল নেই, বিপদের আশঙ্কা নেই। তবু এক অজানা অস্বস্তি ছড়িয়ে এই অঞ্চল জুড়ে। যাকে বলা হয় ডিএমজেড (DMZ) বা ‘কোরিয়ান ডিমিলিটারাইজড জোন’। উত্তর কোরিয়ার দিকের গ্রাম কিজং ডং (Kijong Dong), যার অর্থ শান্তির গ্রাম। আর দক্ষিণ কোরিয়ার দিকেরটির নাম ডেসিওং ডং (Daeseong Dong), অর্থাৎ স্বাধীনতার গ্রাম। অবশ্য শব্দদুটির কোনো প্রয়োগই এই গ্রামে প্রচলিত নয়।

প্রথমে আসা যাক ডেসিওং ডং-এর কথায়। মোট ২২৬টি পরিবার বাস করে এখানে। এরা মূলত এই অঞ্চলেরই আদি বাসিন্দা। যদিও জীবনযাত্রায় প্রতি মুহূর্তে বাধার মুখে পড়তে হয় তাদের। সর্বক্ষণ সঙ্গে রাখতে হয় পরিচয়পত্র। নিজের গ্রামে ঢোকা বা বেরোনোর সময় প্রত্যেকবার তল্লাশি করা হয়। সন্ধ্যার পর বাড়ির বাইরে বেরোনো দণ্ডনীয় অপরাধ। রাত এগারোটার সময় সেনাবাহিনী প্রতিটি বাড়িতে ঘুরে ঘুরে মিলিয়ে নেয় জনসংখ্যার হিসেবের খাতা। কারণ একসময় উত্তর কোরিয়ার বাসিন্দারা পালিয়ে আশ্রয় নিত এই গ্রামে। কিংবা সেখানকার সেনার দ্বারা অপহরণ করা হত ডেসিওং ডং-এর গ্রামবাসীকে। যদিও বিধিনিষেধ সত্ত্বেও কিছু অতিরিক্ত সুযোগসুবিধা পায় তারা। কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত এই গ্রামের মানুষদের জন্য থাকে বিভিন্ন ভর্তুকির ব্যবস্থা। তাদের কোনো ট্যাক্স দিতে হয় না। এমনকি দক্ষিণ কোরিয়ার বাধ্যতামূলক সেনা প্রশিক্ষণেও যেতে হয় না গ্রামবাসীদের।

এবার আসা যাক কিজং ডং-এর কথায়। বিরাট আকারের সুসজ্জিত বাড়িঘরে পূর্ণ একটি গ্রাম। নতুন রং করা জানলা-দরজা, যত্নের ছাপ সর্বত্র। কিন্তু মজার বিষয় হল, এই গ্রামে কোনো মানুষ থাকে না। ‘শান্তির প্রতীক’ এই গ্রামটি শুধু সাজিয়ে রাখা হয় নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব বোঝানোর জন্য। ১৯৮০ সালে ডেসিওং ডং-এর একটি ৯৮ মিটার উঁচু টাওয়ারে ১৩০ কেজি দক্ষিণ কোরিয়ার পতাকা ওড়ানো হলে, কিছুদিন পরেই উত্তর আসে অন্য কোরিয়া থেকে। কিজং ডং-এ ১৭০ মিটার উঁচু টাওয়ারে বসানো হয় ২৭০ কেজির পতাকা। প্রতিদ্বন্দ্বিতা অবশ্য এখানেই শেষ নয়। ‘প্রোপাগান্ডা’ ছড়ানোর নিত্যনতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে দুই দেশই। ছয়ের দশকে উভয়ই নিজেদের সীমান্তে বসায় অসংখ্য শব্দযন্ত্র। উত্তর কোরিয়ার পক্ষ থেকে সেখানে বাজানো হত তাদের নেতাদের উচ্চস্বরের ভাষণ। দক্ষিণ কোরিয়ায় চলত বিপরীত দেশের দুর্নীতি আর অপশাসনের খবর। ২০০৪ সালে চুক্তির মাধ্যমে সাময়িকভাবে বন্ধ হয় এই শব্দযুদ্ধ। কিন্তু ২০১৬-তে উত্তর কোরিয়ার পরমাণু পরীক্ষার জেরে তৈরি হওয়া টানাপোড়েনে ফের সচল হয়ে ওঠে সেগুলি। এবার আর কোনো বক্তৃতা নয়। দক্ষিণ কোরিয়া থেকে চালানো হয় সে দেশের বিখ্যাত কে-পপ মিউজিক। অন্তত দশ কিলোমিটার পরিধির মধ্যে যে কোনো মানুষের কানে পৌঁছে যায় তার শব্দ।

আরও পড়ুন
এই গ্রামের বাসিন্দা মাত্র একজন!

অবশেষে ২০১৮-তে তা বন্ধ হয়ে গেলেও, কেউ জানে না আবার কবে চালু হবে সেগুলি। ফলে এভাবেই চলছে দুই গ্রামের জনজীবন। বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়ার অংশের অবস্থা বেশ শোচনীয়। কিন্তু দু-দেশই অনড় তাদের নীতিতে। রাজায় রাজায় যুদ্ধে বোধহয় এভাবেই বারবার বিপদে পড়ে উলুখাগড়ারা। 

আরও পড়ুন
মুণ্ড শিকারের গ্রাম! ভারত-মায়ানমার দু’দেশেরই নাগরিক এই গ্রামের বাসিন্দারা

Powered by Froala Editor