২৫ বছর পরে জেগে ওঠা এক 'রূপকথার' শহর

একসময় এখানে ছিল সমৃদ্ধ পর্যটনকেন্দ্র। দেশ-বিদেশের মানুষের সমাগম হত হ্রদের ধারে। নানা খনিজ আকরিকে ভরা ছিল এই হ্রদটি। স্থানীয়রা বিশ্বাস করত, এখানে স্নান করলে অনেক রোগ সেরে যায়। মূলত তারই টানে পর্যটকের আগমন ঘটত এপিকুয়েন হ্রদের (Lake Epecuen) ধারে। যা ছিল প্রাচীন ইন্ডিয়ানদের গ্রাম, তা ক্রমে পরিণত হল ছোটোখাটো এক শহরে। হ্রদের নাম থেকেই তার নাম হল ভিলা এপিকুয়েন (Villa Epecuen)। কিন্তু কে জানত, একদিন এই হ্রদই গিলে খাবে শহরের সর্বস্ব। আবার একদিন ফিরিয়েও দেবে সব কিছু।

কীরকম সেই ঘটনা? ১৯৮৫ সালে আচমকা প্রবল বৃষ্টি আর বন্যায় জলের তলায় ডুবে যায় ভিলা এপিকুয়েন। যার অবস্থান আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়নেস আইরেস থেকে বেশ কিছুটা দূরে। রূপকথার রাজকন্যার মতো সেভাবেই ঘুমিয়ে ছিল টানা ২৫ বছর। তারপর কোনো এক অজানা রাজপুত্রের জাদুকাঠির স্পর্শে ঘুম ভাঙে তার। ধীরে ধীরে কমে যেতে থাকে জলস্তর। ধ্বংসস্তূপে পরিণত শহরটি আবার জেগে ওঠে জলের তলা থেকে। 

গল্পের শুরুটাও হয়েছিল রূপকথা দিয়েই। লেভুস ইন্ডিয়ানদের ভাষায় এপিকুয়েন শব্দের অর্থ ‘পুড়ে যাওয়া’। বাস্তবে জলে ডুবে গেলেও, তাদের লোকবিশ্বাসের সঙ্গে জড়িয়ে এর জন্মরহস্য। বহু যুগ আগে জঙ্গলের এক ভয়ানক আগুনের হাত থেকে একটি শিশুকে কুড়িয়ে পায় তারা। অথচ আগুন স্পর্শ করেনি তাঁর শরীর। সেই শিশুর নাম রাখা হয় এপিকুয়েন। বড়ো হলে তিনি হয়ে ওঠেন লেভুসদের রাজা। প্রতিবেশী এক রাজ্যকে হারিয়ে তিনি জয় করেন রাজকুমারী তিপান্তুকে। যাঁর নামের অর্থ বসন্ত। দুজনের মধ্যে গড়ে ওঠে ভালোবাসার সম্পর্ক। কিন্তু পূর্ণতা পায়নি তাঁদের প্রেমকাহিনি। বিরহী এপিকুয়েনের কান্না থেকেই জন্ম হয় হ্রদটির। 

বিশ শতকের শুরু দিকেই জনসমাগম হতে থাকে এখানে। ছড়িয়ে পড়ে হ্রদের জলের সুখাতি। অনেক অভিযাত্রী জড়ো হন খনিজ পদার্থের আশায়। তারপর হ্রদের তীরবর্তী অঞ্চলে গড়ে ওঠে বড়ো বড়ো হোটেল, রিসর্ট। শহরের নিজস্ব জনবসতি পৌঁছোয় দেড় হাজারে। প্রতি বছর প্রায় পাঁচ হাজার পর্যটকের আগমন হত ভিলা এপিকুয়েনে। ১৯৮৫ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত সবই ঠিকঠাক চলছিল। প্রাকৃতিক দুর্যোগ যে এর মধ্যে আসেনি তা নয়। বড়ো হ্রদের পাশে থাকতে হলে বিপদের আশঙ্কা মাথায় রাখতেই হয়। ১৯৭৫ সালে দুটি বিরাট বাঁধ তৈরি করা হয়েছিল হ্রদের জলোচ্ছ্বাস আটকানোর জন্য। 

আরও পড়ুন
মাটির তলায় ‘গুপ্ত’ শহর, কোন বিপদের প্রস্তুতি?

কিন্তু ১৯৮৫-র বর্ষাকালে শুরু হল প্রবল বৃষ্টি। এমন বৃষ্টিপাত এপিকুয়েনের বাসিন্দারা আগে কখনও দেখেনি। সাধারণত, সেপ্টেম্বরেই বর্ষাকাল বিদায় নেয় এখানে। অথচ এবার নভেম্বর মাসেও বর্ষাবিদায়ের নাম নিচ্ছে না। নিকাশীব্যবস্থাও ক্রমে বেহাল হতে শুরু করেছে। শহরের অনেক জায়গাতেই জমে আছে জল। তার মধ্যেই ৬ নভেম্বর ভেঙে গেল হ্রদের প্রথম বাঁধটি। ১০ নভেম্বর ভাঙল দ্বিতীয়টি। সারা শহর তখন জলমগ্ন। কোনো প্রাণহানির ঘটনা না হলেও, ধীরে ধীরে শহর ছাড়তে শুরু করে সাধারণ মানুষ। অন্যদিকে ক্রমশ বাড়তে থাকে জলস্তর। ১৯৯৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, ভিলা এপিকুয়েন ১০ ফুট জলের তলায় ডুবে গেছিল।

আরও পড়ুন
বাস্তবের প্রেরণাতেই তৈরি ব্যাটম্যানের শহর ‘গথাম’

এভাবেই কেটে গেল ২৫ বছর। স্থানীয় বাসিন্দারা ছাড়া লোকে ভুলেই যেতে বসল এপিকুয়েনের নাম। অবশেষ ২০০৯ সাল নাগাদ কমতে শুরু করে জলস্তর। যেন সদ্যস্নাতা এক রাজকুমারী উঠে এলেন হ্রদ থেকে। কিন্তু জীবন্ত নয়, তার কঙ্কাল। এত বছর জলের তলায় থাকায় স্বাভাবিকভাবেই সার্বিক কাঠামো ভেঙে পড়েছে এপিকুয়েনের। শুধু রয়ে গেছে ধ্বংসাবশেষ। পুরনো বাসিন্দাদের অনেকেই আশা নিয়ে ফিরে এসেছিলেন। যদি ফিরিয়ে আনা যায় শহরের প্রাচীন গরিমা। তা আর সম্ভব হয়নি। উৎসাহ দেখায়নি সরকারও। শুধু পাবলো নোভাক নামের এক অশীতিপর বৃদ্ধ রয়ে গেছিলেন জীবনের শেষ দিনগুলি কাটানোর জন্য। 

লেভুসদের রূপকথার গল্পের শেষটা এখানে বলা যেতে পারে। যেখানে তিপান্তু ডুবে গেছিলেন জলার তলায়। কিন্তু কোনোদিন কি শাপমুক্ত হয়ে ফিরে আসতে পেরেছিলেন তিনি? নাকি এই শহরের মতো তাঁর অতৃপ্ত সত্তার দীর্ঘশ্বাস ঘুরে বেড়ায় এখানে। জানা যায় না। নটে গাছ মুড়িয়েছে তার আগেই। 

Powered by Froala Editor