ওস্তাদ বিলায়েৎ খাঁ আর পণ্ডিত রবিশঙ্করের ডুয়েলের 'কাহানি'

এই নিয়ে ঝামেলার কোনো শেষ নেই। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের ফুটবল ম্যাচে যেমন হয় আরকি। মাঠে খেলোয়াড়রা খেলে এক খেলা। আর গ্যালারিতে বসে দুর্দম্য খেলায় মেতে ওঠে ভক্তগণ। সে খেলা থামাতে মারদাঙ্গা, লাঠিচার্জ - সবই চলে। ওস্তাদ বিলায়েৎ খাঁ ও ওস্তাদ রবিশঙ্করের ভক্তদের মধ্যে অনেকটা এমনই তরজা বহিমান সবসময়। অন্তত একসময় ছিল। সেই তরজা পল্লবিত হয়ে বিশ্বযুদ্ধ বাঁধিয়ে দিত প্রায়।

শোনা যায়, রবিশঙ্কর যে অনুষ্ঠানের 'শো স্টপার' হতেন, সেখানে নাকি উপস্থিতই হতেন না বিলায়েৎ খাঁ। কোনো অনুষ্ঠানে তাঁর নাম রবিশঙ্করের পরে উচ্চারিত হলে তৎক্ষণাৎ তা নাকচ করতেন। যদিও এর অনেকটাই রটনা। আর সেই রটনায় ইন্ধন যুগিয়েছিল, একটি একটি ইংরেজি পত্রিকা।

শ্রোতাদের অনুরোধেই বাজনা শুরু করেছিলেন, বিলায়েৎ খাঁ ও রবিশঙ্করজি। তবলায় সেদিন ছিলেন কিষেণ মহারাজ ও কেরামত খাঁ। মাঁজ খাম্বাজের ঠুংরি অঙ্গের বাজনা। মুশকিল হয়েছিল, বাজনা শুরু হওয়ার পর। বিলায়েৎ খাঁ আর রবিশঙ্করকে ঘিরে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গিয়েছিল সমস্ত শ্রোতা। তাদের মন্তব্য, প্রশংসা বা নিন্দা ছুড়ে দেওয়া- সবমিলিয়ে অদ্ভুত টেনশন তৈরি হয়েছিল বাজনাকে ঘিরে। আর সেটার সুযোগ নিয়েছিল, ইংরেজি পত্রিকাটি। তারা লিখেছিল, বিলায়েৎ খাঁর সঙ্গে নাকি সেদিন পেরে ওঠেননি রবিশঙ্কর। বিলায়েৎ খাঁ ঝালা বাজানোর নাকি সময় চারটে টোকা দিয়েছিলেন।আর রবিশঙ্কর নাকি তাতে মিলতে পারেননি। তাই তিনি তিনটে টোকায় কাজ সেরেছিলেন। ব্যস, এইসব লেখার পর গোটা বোম্বে জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল-- বিলায়েতের কাছে পরাজিত রবিশঙ্কর। আর এইসব দেখেশুনে খুব রেগে গিয়েছিলেন তিনি। এতই সে রাগ, যে বিলায়েৎ খাঁকে ওপেন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন। বোম্বের তারদেও এলাকায় যোশীপুরাজির বাড়িতে। সেখানে সেদিন বাস্তবিকই চাঁদের হাট। আলি আকবর খাঁ, কিষেণ মহারাজ, যশবন্তরাও পুরোহিত সামনে উপস্থিত। শর্ত ছিল, একজনের পছন্দমতো রাগ ও অন্যজনের পছন্দসই তালে চলবে প্রতিযোগিতা।

কিন্তু বিলায়েৎ খাঁ সে প্রতিযোগিতায় লড়লেন না। ছাত্র অরবিন্দ পারেখকে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়ে, প্রথমেই শান্তির পায়রা ওড়ালেন। সমস্ত ব্যাপার মিটিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দিলেন। বললেন, লোকের কথায় কান না দিতে। এইজাতীয় 'লড়াই' ঝামেলা নাকি সঙ্গীতের পক্ষে খুব ক্ষতিকর। এইসব 'মারদাঙ্গা' থেকে সেদিন খাঁ সাহেবই সরিয়ে এনেছিলেন রবিশঙ্করকে।

সেতারের সমসাময়িক দুজন তারকা। তারকা না বলে কিংবদন্তীও বলা যায়। শোনা যায়, বিলায়েতের বাজনায় মুগ্ধই ছিলেন রবিশঙ্করজি। তাঁর বাজনাকে বলতেন- 'Combination of romanticism and buoyancy…' সেটাই তাঁর জোরের জায়গা। অথচ, এইসব স্বীকারোক্তির পরেও, দুজনকে নিয়ে দ্বন্দ্বের শেষ নেই। এই 'দ্বন্দ্ব'টি যদি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শেষমেশ না পৌঁছাত তাহলে হয়তো আমরা আরো অনেক অবিস্মরণীয় যুগলবন্দীর সাক্ষী হতে পারতাম।