এ এক আজব পাঠশালা। সেখানে রোজ সকালে এসে ভিড় করেন আট থেকে আশি সকলেই। বাগান পেরিয়ে ছোট্ট স্কুলবাড়ি। আর তার দরজার সামনেই একটি প্রাণীর মূর্তি। পৃথিবীর একমাত্র আঁশযুক্ত স্তন্যপায়ী প্রাণী। প্যাঙ্গোলিন। পাঠশালার পড়াশোনার বিষয়ও বন্যপ্রাণ। আরও নির্দিষ্টভাবে বললে, প্যাঙ্গোলিন। কীভাবে বাঁচানো যায় এই প্রাণীকে, আহত প্যাঙ্গোলিনের চিকিৎসাই বা কীভাবে সম্ভব? সবই হাতে কলমে শিখিয়ে দেন ভিয়েতনামের পরিবেশকর্মী থাই ভান নিগুয়েন। শুধুই পড়শোনা নয়, প্যাঙ্গোলিন এবং অন্যান্য বন্যপ্রাণীদের বাঁচাতে আস্ত একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করে ফেলেছেন তিনি। ‘সেভ ভিয়েতনাম’স ওয়াইল্ড লাইফ’ নামের এই নেটওয়ার্কের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে সে-দেশের বনবিভাগও।
যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালে। ততদিনে প্যাঙ্গোলিন পাচার ও তার সুরক্ষা নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে। কিন্তু জঙ্গলের গা ঘেঁষে থাকা গ্রামগুলিতে তেমন কোনো সচেতনতাই চোখে পড়েনি নিগুয়েনের। তিনি বুঝেছিলেন, চোরাশিকারীদের হাত থেকে এই বিপন্ন প্রাণীটিকে রক্ষা করতে গেলে সবার আগে প্রয়োজন গ্রামবাসীদের সচেতন করে তোলা। শুরু হল এই পাঠশালার কাজ। গ্রামবাসীদের সঙ্গে নিয়েই জঙ্গল পরিদর্শনে বেরোতেন নিগুয়েন। প্রথম কাজ শুরু হয় কুক ফুয়োং ন্যাশানাল পার্কের কাছে। নিগুয়েন দেখিয়ে দিতেন প্যাঙ্গোলিন ধরার জন্য শিকারীরা যে ফাঁদ পাতে তা কেমন দেখতে হয়। কীভাবেই বা সেইসমস্ত ফাঁদ অকেজো করা যায়। আবার ফাঁদের মধ্যে কোনো প্যাঙ্গোলিন ধরা পড়লে তাকে উদ্ধারের পদ্ধতিও দেখিয়ে দিতেন তিনি। আর রিহ্যাবিলিয়েশন সেন্টারে এসে চলত আহত প্যাঙ্গোলিনদের চিকিৎসার কাজ।
ইন্টারন্যশানাল ইউনিয়ন ফর কনসার্ভেশন অফ নেচারের রিপোর্ট অনুযায়ী সারা পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি পাচার হয় যে প্রাণীটি, সেটি প্যাঙ্গোলিন। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রায় ৯ লক্ষ প্যাঙ্গোলিন পাচারের তথ্য জানা গিয়েছে। শুধু ২০১৯ সালেই পাচার হয়েছে অন্তত ১ লক্ষ ৯৫ হাজার প্যাঙ্গোলিন। আর এর বেশিরভাগটাই ঘটে দক্ষিণ এশিয়ায়। তার কারণ এক বিশেষ ধরণের লৌকিক বিশ্বাস। চিন, কোরিয়া, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশের মানুষের বিশ্বাস সাধারণ সর্দিকাশি থেকে ক্যানসার পর্যন্ত যাবতীয় রোগ সারিয়ে তুলতে পারে প্যাঙ্গোলিনের আঁশ। আর তাই কালো-বাজারে এর দাম প্রতি কেজিতে অন্তত ৭৫০ মার্কিন ডলার।
নিগুয়েনের মতে প্যাঙ্গোলিন যে শুধু বিপন্ন প্রাণী তাই নয়, এটি এখনও অবধি টিকে থাকা একমাত্র আঁশযুক্ত স্তন্যপায়ী প্রাণী। আর তাই জীববৈচিত্রে প্যাঙ্গোলিনের ভূমিকা অনেকটাই বেশি। প্যাঙ্গোলিন বিলুপ্ত হয়ে গেলে প্রাণীজগতের সার্বিক ভারসাম্যই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর সবচেয়ে বড়ো কথা, ছোট্ট এই প্রাণীটি মানুষের কোনো ক্ষতিই করে না। মানুষকে কামড়াতে পারে না, তার চাষের জমি নষ্ট করে না। বরং মানুষের সঙ্গে খুব সহজেই ভাব জমিয়ে নিতে পারে প্যাঙ্গোলিন। কিন্তু এই স্বার্থপর প্রজাতিটি কি সহজে অন্য কাউকে বন্ধু বলে স্বীকার করতে পারে? পারে, যদি নিগুয়েনের মতো শিক্ষক থাকেন। কুক ফুয়োং ন্যাশানাল পার্কের পাশাপাশি এখন পু-মাত ন্যাশানাল পার্কেও একটি রিহ্যাবিলিয়েশন সেন্টার তৈরি করেছেন নিগুয়েন। সাধারণ গ্রামবাসীদের পাশাপাশি বনবিভাগের পদস্থ কর্মচারীদেরও ট্রেনিং দেন তিনি। তাঁদের শেখান ড্রোন এবং অন্যান্য অত্যাধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করে কীভাবে জঙ্গলের গভীর পর্যন্ত নজরদারি চালানো যায়।
আরও পড়ুন
পোষ্য প্রাণীদের দূরে সরিয়ে দেবেন না, আগলে রাখুন মহামারীতেও
৭ বছরে ১৫৪০টি প্যাঙ্গোলিনকে পাচারের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন নিগুয়েন। ৯৭০১টি গোপন ফাঁদ খুঁজে সেগুলি নষ্ট করে দিয়েছেন। ধরিয়ে দিয়েছেন চোরাশিকারীদের ৭৭৫টি গোপন আস্তানা। তাঁর এই কাজের স্বীকৃতি হিসাবে সম্প্রতি গোল্ডোম্যান পুরস্কারের জন্যও মনোনিত হয়েছেন তিনি। অবশ্য নিগুয়েন মনে করেন তিনি জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার সেদিন পাবেন, যেদিন বিপন্ন প্রাণীর তালিকা থেকে প্যাঙ্গোলিনের নাম বাদ যাবে। আর প্রতিটা মানুষই আগলে রাখতে শিখবে এই নিরীহ প্রাণীটিকে।
আরও পড়ুন
উটেদের জন্য ট্রাফিক সিগন্যাল, প্রাণী সুরক্ষায় পথ দেখাচ্ছে চিন
Powered by Froala Editor