আজ ২৬ সেপ্টেম্বর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের (Iswarchandra Vidyasagar) জন্মদিন। দিনটির পরিচয় যেন এতটুকুই। দেশের নানা কিংবদন্তি মানুষের জন্মদিনকে স্মরণীয় করে রাখতে যেখানে দিনগুলিকে নানাভাবে চিহ্নিত করা হয়, সেখানে বিদ্যাসাগরের জন্মদিনকে সম্মান জানানো হয়নি আজ পর্যন্ত। অথচ এই মানুষটির হাত ধরেই বঙ্গীয় নবজাগরণ পরিণত হয়েছিল। বাংলাকে তো বটেই, গোটা ভারতকে যুক্তির মশাল জ্বেলে আলো দেখিয়েছিলেন তিনি। বিগত বেশ কয়েক বছর ধরেই তাই দাবি উঠছে, ২৬ সেপ্টেম্বর দিনটিই শিক্ষক দিবস (Teachers’ Day) হিসাবে পালন করা হোক। সম্প্রতি এই মর্মে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে একটি দাবিপত্র পেশ করেছে একটি সংগঠন। জাতীয় শিক্ষক দিবসের পাশাপাশি এই দিনটিকে রাজ্যের শিক্ষক দিবস হিসাবে ঘোষণা করা হোক, দাবি এমনটাই। আর সেই দাবিপত্রে স্বাক্ষর করেছেন বাংলার বহু বুদ্ধিজীবী। তবে বিদ্যাসাগরের কৃতিত্বকে কীভাবে স্মরণ করা যেতে পারে, তাই নিয়ে নানা ধরণের বক্তবই উঠে আসছে বুদ্ধিজীবী মহলের ভিতর থেকে।
এই প্রসঙ্গে কবি বিভাস রায়চৌধুরী প্রহরকে জানালেন, তিনি এই দাবির সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে সহমত। এমনকি ভবিষ্যতে এই দাবির সমর্থনে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতেও রাজি আছেন তিনি। তাঁর মতে, “বিদ্যাসাগরের মতো চরিত্রই একজন আদর্শ শিক্ষকের মাপকাঠি হওয়ার যোগ্য। তিনি শিক্ষাব্যবস্থায় বিপ্লব আনার পাশাপাশি সমাজ গঠনের কাজেও ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। ছাত্রদের থেকে শুরু করে সমস্ত গুণী মানুষের পাশে থেকেছেন সবসময়। অতএব বিদ্যাসগরের জন্মদিনকে শিক্ষক দিবস হিসাবে ঘোষণা করার চেয়ে যথার্থ দাবি আর কিছু হতে পারে না।” একই বক্তব্য সাহিত্যিক কিন্নর রায়েরও। তাঁর মতে, কেন্দ্রের শাসকগোষ্ঠী বরাবর বাঙালিকে বঞ্চনা করে এসেছে। আর সেই কারণেই বিদ্যাসাগরের মতো কিংবদন্তি কোনো সম্মান পেলেন না। তিনি বলছিলেন, “সত্তরের কালবেলায় যে বিচ্যুতি ঘটেছিল, যে কারণে বিদ্যাসাগর থেকে প্রফুল্লচন্দ্রের মতো মানুষের মূর্তি ভাঙা হয়েছিল, তা যে ভুল হয়েছিল সে-কথা আন্দোলনের নেতারাও পরে স্বীকার করেছেন। বিদ্যাসাগর নিরীশ্বরবাদী ছিলেন না, তাঁকে নিরীশ্বরবাদী প্রমাণ করারও কিছু নেই। কিন্তু বঙ্গীয় নবজাগরণের মতো ঘটনায় তাঁর ভূমিকাকে অস্বীকার করার কোনো জায়গাই থাকতে পারে না।” কিন্নর রায় আরও বলছিলেন, “বিদ্যাসাগর শুধু বাঙালির নন, বরং সারা দেশের কাছেই একজন অগ্রণী মানুষ। তাই জাতীয় শিক্ষকদিবস যদি সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণনের জন্মদিনের বদলে বিদ্যাসাগরের জন্মদিনে পালিত হয়, তাহলেই ইতিহাসের মর্যাদা দেওয়া হবে।”
তবে বিভাস রায়চৌধুরী বা কিন্নর রায়ের বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন সাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্তী। তিনি বলছেন, “রাধাকৃষ্ণনের জন্মদিনের বদলে বিদ্যাসাগরের জন্মদিনকে শিক্ষক দিবস হিসাবে ঘোষণা করলে রাধাকৃষ্ণনকে তো অপমান করা হবেই, সেইসঙ্গে বিদ্যাসাগরকেও খুব একটা সম্মান জানানো হবে না। যেন তাঁকে জোর করে রাধাকৃষ্ণনের জায়গায় বসিয়ে দেওয়া হবে।” প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ঋতম মুখোপাধ্যায়ও প্রায়ই একই কথা বললেন। তাঁর কথায়, “একজনকে সম্মান দেওয়া মানে তো আরেকজনকে অসম্মান করা নয় কখনোই। বিদ্যাসাগরের জন্মদিনকে রেড লেটার ডে হিসাবে ঘোষণা করার পক্ষে আমরা সবাই। তার থেকে আনন্দের আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু সেটা রাধাকৃষ্ণনকে অপমান করে সম্ভব নয়।”
এই বক্তব্যের সঙ্গেই এসে পড়ছে রাধাকৃষ্ণনকে নিয়ে প্রচলিত একটি বিতর্কের কথাও। তাঁর একটি গবেষণাপত্র ‘চুরি’-র ঘটনা নিয়ে আলোচনা চলছে বহুদিন ধরেই। তবে ঋতম মুখোপাধ্যায় মনে করেন, “সেই বিতর্কের তো কোনো মীমাংসা হয়নি। আর তিনি পণ্ডিত মানুষ ছিলেন না এমন মনে করারও কোনো কারণ নেই।” স্বপ্নময় চক্রবর্তীও বলছেন, “বিতর্ক তো সব কিংবদন্তিকে নিয়েই আছে।” তবে জাতীয় শিক্ষক দিবসের পাশাপাশি যদি বিদ্যাসাগরের জন্মদিনকে রাজ্যের শিক্ষক দিবস হিসাবে ঘোষণা করা হয়, তাহলে সেই দাবির পক্ষে সমর্থন জানিয়েছেন অধ্যাপক মুখোপাধ্যায়। অন্যদিকে স্বপ্নময়বাবুর কথাও, “এও এক ধরণের বিচ্ছিন্নতাকে প্রশ্রয় দেওয়া। কেন শিক্ষক দিবসই ঘোষণা করতে হবে? বিদ্যাসাগর তো গোটা সমাজের সঙ্গেই মিশে আছেন।”
আরও পড়ুন
বিদ্যাসাগরের জন্মদিনে অভিনব শ্রদ্ধার্ঘ, চালু হল তাঁর নামাঙ্কিত কমিউনিটি রেডিও
এই সমস্ত বিতর্কের মধ্যেই নাট্যকার রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তর বক্তব্য যেন সবার থেকে আলাদা। তিনি বললেন, “বিদ্যাসাগরের জন্মদিনকে আমরা স্মরণ করি বা না করি, তা আমাদেরই স্বার্থে। এতে তাঁর তো কিছু এসে যায় না।” তিনি আরও বললেন, “বিদ্যাসাগরের মতো মানুষরা, তাঁরা সূর্যের মতো। প্রশংসা-অপমান সবকিছুর পরেও তাঁরা উজ্জ্বল থাকবেন। কখনও একটু বেশি উজ্জ্বল থাকবেন, কখনও একটু কম উজ্জ্বল থাকবেন। কিন্তু তাঁরা থেকে যাবেনই। আজকের ইতিহাসটাই তো তাঁদের বাদ দিয়ে তৈরি হয় না।”
আরও পড়ুন
‘এ জন্মের মতো বিদায় লইতেছি’; মা-কে চিঠি লিখলেন অভিমানী বিদ্যাসাগর
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
বিরোধীরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ, ‘গণতান্ত্রিক’ পথেই জয় এনেছিলেন বিদ্যাসাগর