দুশো বছর হয়ে গেল তাঁর জন্মের। তবু তাঁকে নিয়ে মিথের অবসান হল না। বাঙালির বিদ্যাসাগরকে নিয়ে অদ্ভুত একটা অস্বস্তি আছে। চিরকালের। রেনেসাঁ যুগের একমাত্র মানুষ যিনি শহর কলকেতার বাবু নন। বড় ঘরের কেউকেটা নন যিনি অবসর সময়ে রিফর্ম করেন। তিনি একক। তাঁর সমান কেউ ছিল না। তিনি নিজেও সেটা জানতেন। তাঁর কন্যা বিনোদিনীর দ্বিতীয় কন্যা সরযূবালা তো লিখেইছেন “তাঁহার একটি বিশেষ অহঙ্কার ও আত্মাভিমান জন্মে। তিনি নিজেকে ক্ষণজন্মা পুরুষ মনে করিতেন এবং কখনো কাহারো সহিত মিলেমিশে ঐক্যমতে কোন কাজ করিতে পারিতেন না। যশোলিপ্সা ও নিন্দাভয় তাঁহার আর একটি চরিত্রগত ত্রুটি ছিল।”
দোষে গুণে মানুষ। যে তারানাথ তর্কবাচস্পতিকে নিজের পদ ছেড়ে দিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর, বলেছিলেন "আমার চেয়ে অনেক বড় পণ্ডিত, নিয়োগপত্র পাওয়ার যোগ্যতা তাঁরই আছে", তাঁর সঙ্গেই কলের জল পান করলে ধর্মনাশ হবে কিনা এই নিয়ে বিদ্যাসাগর আর তারানাথের ছেলে জীবানন্দর মধ্যে বিরোধ বাঁধল। বিদ্যাসাগর উঠে পড়ে লাগলেন তারানাথকে হেয় করতে। “অতি অল্প হইল” আর “আবার অতি অল্প হইল”-তে তারানাথের বহুবিবাহ শুধু নয় নানা বাছা বাছা বিশেষণে তাঁর অপমান করলেন তিনি। অনেকসময় তা নিতান্ত ব্যক্তিগত আক্রমণ। লিখলেন, ‘অতি দর্পে লঙ্কাপতি সবংশে নিপাত।/ অতি দর্পে বাচস্পতি তব অধঃপাত।।’ বহুবিবাহবাদ পুস্তিকায় শিক্ষকসম তারানাথকে উদ্দেশ্য করে ঈশ্বরচন্দ্র একেবারে ব্যক্তিগত আক্রমণের স্তরেও নেমেছেন। বলেছেন “শাস্ত্রীয় বিষয়ে তিনি সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাচারী” কিংবা “ উনি যাহাতে সুবিধা দেখেন তাহাই বলেন”। ভুলে গেলেন তাঁর সন্তান নারায়ণচন্দ্রের বিধবা বিবাহের পর কেউ যখন তাঁদের বরণ করতে রাজি ছিল না, তখন এই তারানাথই তাঁর স্ত্রীকে দিয়ে নবদম্পতিকে নিজ গৃহে বরণ করেছিলেন। কিংবা এই তারানাথই সমাজের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে বেথুন স্কুলে মেয়ে জ্ঞানদা দেবীকে পাঠিয়েছিলেন। অনুজের এই স্পর্ধায় কিছু বলেননি তারানাথ। নিজেকে ডুবিয়ে দিলেন সংস্কৃত পুঁথির টীকা করা বা বই ছাপানোর কাজে। তিনি না থাকলে আদর্শ সংস্কৃত ব্যাকরণ লেখাই হত না। কিন্তু বিদ্যাসাগর তাঁর পিছনে লেগে গেলেন। যে তারানাথ লক্ষ টাকার ব্যবসা ফেলে শুধু বিদ্যাসাগরের কথায় নব্বই টাকা মাস মাইনের চাকরি করতে এসেছিলেন, শুধু নবলব্ধ ক্ষমতার বলে ব্যক্তি তারানাথকে ধ্বংস করতে মরিয়া হয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। এতটাই যে বিদ্যাসাগরের অনুজ শম্ভুচন্দ্র তারানাথের একটা জীবনী লিখলেও বিদ্যাসাগরের জীবৎকালে প্রকাশ করতে পারেননি। বিদ্যাসাগর অনুমতি দেননি।
শেষে আর একজনের কথা বলি। দীনময়ী দেবী। তাঁর প্রতি কি বিদ্যাসাগর নিজের কর্তব্য করেছিলেন? একটু উদ্ধৃতি দেওয়া যাক।
'১৮৪৯-এ ড্রিঙ্ক ওয়াটার বেথুন কলকাতায় হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করলেন (বর্তমানে বেথুন স্কুল), যার অবৈতনিক সম্পাদকের দায়িত্ব নিলেন বিদ্যাসাগর। নারীশিক্ষার উন্নয়নে দেশবাসী ও সমাজকে সচেতন করতে বেথুন স্কুলের ছাত্রীদের গাড়ির দুই পাশে লিখে দিলেন ‘মহানির্বাণতন্ত্র’-এর সেই বিখ্যাত শ্লোক— ‘কন্যাপ্যেবং পালনীয়া শিক্ষনীয়াতিযত্নতঃ।’ অর্থাৎ কন্যাকেও অতি যত্ন সহকারে পালন করা ও শিক্ষা দেওয়া কর্তব্য। যার হাতে স্ত্রী শিক্ষার প্রদীপ, বীরসিংহে তার ঘরেই আঁচলে অশিক্ষার অন্ধকার বেঁধে স্ত্রী দীনময়ী যাপন করে চলেছেন শিক্ষাহীন বন্ধ্যা সকাল-দুপুর-রাত। বিদ্যাসাগরের জীবনীকার এস কে বসু তাঁর ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’ গ্রন্থে বলেছেন—‘‘ভাবলে অবাক হতে হয় যে, বিদ্যাসাগরের মতো বিখ্যাত স্বামীর ঘটনাবহুল জীবনে তাঁর স্ত্রী দীনময়ী দেবীর কোনো ভূমিকাই ছিল না। নিজে স্ত্রী শিক্ষার অতি আগ্রহশীল সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও তাঁর স্ত্রীকে লেখাপড়া শেখাননি।’’ সংসারে দীনময়ীর ভূমিকা ছিল আজ্ঞাবাহী মাত্র। সেই দীন্ময়ীকেই দিনের পর দিন চিঠিতে “তোমার পুত্র অমানুষ” বলে যাতনা দিয়েছেন। ইচ্ছাপত্রে ভাই শম্ভুচন্দ্র, দীনবন্ধুর জন্য মাসিক ৪০ টাকা বরাদ্দ হলেও দীনময়ির জন্য মাত্র ৩০ টাকা। তখনকার দিনে এই তফাতটা অনেকটাই। ১৮৭৬ এ যখন প্রথমবার প্রৌঢ়া দীনময়ীর স্বামী সঙ্গলাভের সুযোগ এল তাঁর আগে তাঁর স্বামী জানালেন “আমার সাংসারিক সুখভোগের বাসনা পূর্ণ হইয়াছে” বলে বললেন স্বামীর সংসার করার জন্য এত তাড়াহুড়ো না করতে। “নতুবা স্বয়ং যথেষ্ট ক্লেশ পাইবে এবং অন্যেরও বিলক্ষণ ক্লেশদায়িনী হইবে”। এই ক্লেশ বেশিদিন ভোগ করতে হয়নি বিদ্যাসাগরকে। স্বামীর মৃত্যুর তিন বছর আগেই দীনময়ী পরপারে চলে যান।
বিদ্যাসাগর নিজে কি সুখী ছিলেন? বিহারীলাল সরকার লিখছেন “প্রায়ই চোখের জল ফেলিতে ফেলিতে তিনি বলিতেন’ সন্তুষ্ট কাহাকেও করিতে পারিলাম না। আমার কথামালায় যে বৃদ্ধ ও ঘোটকের কথা আছে, আমিই সেই বৃদ্ধ”। শেষ বয়সে আঁকড়ে ধরেছিলেন ইংরেজি জানা জামাই হেয়ার স্কুলের শিক্ষক সূর্যকুমারকে। তাঁকে মেট্রোপলিটন ইন্সটিটিউশানের অধ্যক্ষ বানালেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ছাব্বিশ। তাঁর অধীনের প্রায় সবাই তাঁর চেয়ে বড়। নালিশ আসতে থাকল বিদ্যাসাগরের কাছে। কিছু সত্যি। কিছু মিথ্যে। এদিকে স্ত্রী মারা গেছেন। মা মারা গেছেন। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত বিদ্যাসাগরের কাছে জামাইয়ের নামে একের পর এক বেনামী চিঠি আসতে শুরু করল। সে নাকি ঠিকঠাক কাজ করছে না। বিদ্যাসাগর কিছুমাত্র বিচার না করে তাঁকে পদচ্যুত করলেন। তিন বছর কলকাতায় কর্মহীন হয়ে ঘুরলেন সূর্যকুমার। বিদ্যাসাগর একটিবারও সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেননি। শিবনাথ শাস্ত্রী তো লিখেই ছিলেন “বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রকৃতি তো জানাই আছে, তাঁর কাছে স্বর্গ-নরক ভিন্ন মাঝামাঝি একটা স্থান নাই। যাহাকে ভাল জানিবেন তাঁহাকে স্বর্গে দিবেন, যাহাকে মন্দ জানিবেন তাঁহাকে নরকে দিবেন।”
বিদ্যাসাগরের এই পুন্নাম নরকে একের পর এক পতিত হয়েছিলেন তাঁর আত্মীয়রা। কাছের মানুষরা। সবার মাঝে একলা হয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। তাঁর নিজের দৌহিত্রী, সূর্যকুমারের কন্যা এই দয়ার সাগরের সম্পর্কে লিখতে বাধ্য হন “অকারণ একটি নিরীহ জীবাত্মার সমূলে উচ্ছেদ সাধন অতি গুরুতর মহাপাপ। এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত আছে বলিয়া আমাদের বিশ্বাস নাই।”
আরও পড়ুন
বিদ্যাসাগরের জন্মদিনেই পালিত হোক শিক্ষক দিবস, আবেদন নেটিজেনদের
দৌহিত্রীর কাছে এই সম্ভাষণ কি ঈশ্বরচন্দ্রের প্রাপ্য ছিল? কে জানে!
তথ্যসূত্র-
১। সরযূবালা দেবী- দৈব ও পুরুষকার কিংবা দৌহিত্রীর দৃষ্টিতে বিদ্যাসাগর। সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা, ১১২ বর্ষ, ১ম-২য় সংখ্যা, ১৪১২
২। বিহারীলাল সরকার- বিদ্যাসাগর
৩। শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন- বিদ্যাসাগর জীবনচরিত ও ভ্রমনিরাশ
৪। প্রলয় চক্রবর্তী- ঈশ্বরচন্দ্র- একক ছিলেন পরিবারেও, থির বিজুরী, বর্ষ-৭, সংখ্যা-১,২
৫।অপূর্ব সাহা- বিদ্যাসাগর ও তারানাথ তর্কবাচস্পতি, বন্ধুত্ব ও বিসংবাদ, থির বিজুরী, বর্ষ-৭, সংখ্যা-১,২
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
নিমতলা শ্মশানে তোলা হয়েছিল বিদ্যাসাগরের মরদেহের ছবি, ১২৯ বছর পর সেখানেই বসছে ফলক