সময়টা উনবিংশ শতক। কলকাতা তো বটেই, সারা বাংলার বুকে সমাজের ছবিটা একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে। রক্ষণশীল পাঁচিলের গায়ে আঘাত পড়ছে; শিক্ষার আলো পেয়ে এত বছরের জংধরা চাকাটা যেন একটু হলেও প্রাণ পাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতেই শহরের বুকে শেষ দিনগুলো গুনছেন এক বৃদ্ধ। আসল বাড়ি বীরভূম। ঠিক করলেন, শেষ যাত্রাটা যেন কাশী থেকেই হয়। সেখানেই যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন; বাধা দিল বড়ো ছেলে। তাঁর অনুরোধে কাশী নয়, বরং নিজের গ্রাম বীরসিংহে ফিরতে কোনোমতে রাজি হলেন তিনি। কিন্তু অন্য ছেলের মতে, এভাবে সংসারে চলে আসাটা বৃদ্ধ ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঠিক হবে না। তাঁর কাশীবাসীই হওয়া উচিত। শেষ পর্যন্ত তাই হল। বড়ো ছেলে খানিক ক্ষুণ্ণ হলেন, কষ্টও পেলেন। তিনি তো বাবার কথা ভেবেই গ্রামে ফিরতে বলেছিলেন। এবার কাশী গেছেন, তাঁর খেয়াল-খবর রাখতে হবে না! কাজেই বারবার যেতে লাগলেন সেখানে। তাঁর নিজেরও শরীর খারাপের ভয় আছে। কিন্তু তিনি ভয় পান না সেসবের; নামটি যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর! বাবার প্রতি তো তাঁর একটা কর্তব্য আছে। সেই ‘ডিউটি’ বা দায়িত্ববোধ থেকেই সেখানে যাওয়া। এত ভাবলে চলে!
সারাটা জীবন এই দায়িত্বের মধ্যেই থেকেছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। কখনও সমাজের প্রতি, কখনও পিছিয়ে পড়া মানুষদের প্রতি, আবার কখনও পরিবারের প্রতি। কোথাও কোনো কমতি রাখেননি। বলা ভালো, রাখতে দেননি। নিজের সর্বস্ব দিয়ে যা ঠিক মনে করেছেন, সেটাই করেছেন। পাঠক, মনে পড়ে বিধবা বিবাহ আইন প্রবর্তনের আগের পরিস্থিতির কথা? বিদ্যাসাগরকে পদে পদে অপমান সহ্য করতে হয়েছে। এমনকি প্রাণে মারারও চেষ্টা করা হয়েছে। ব্রাহ্মণ হয়ে কিনা বিধবাদের আবার বিয়ে দেবেন? ‘ঘোর কলি’! সমস্ত প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে গিয়ে হেঁটেছিলেন তিনি। তাঁর লক্ষ্য একটাই, সমাজের মেয়েরা যাতে এভাবে হারিয়ে না যায়। মেয়েদের শিক্ষার জন্য সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করেছেন। কীসের জন্য? এখানে নিজের স্বার্থ কোথায়? জীবনের শেষ পর্বে যখন কর্মাটাড়ে আছেন, তখনও সেখানকার আদিবাসী মানুষদের জন্য ভেবেছিলেন।
সবই ছিল, কিন্তু সেইসঙ্গে ছিল বারবার আঘাত সহ্য করাও। সমাজের কথা অন্য কোনো প্রতিবেদনে বলা যাবে। কিন্তু তারও আগে যে আসে নিজের পরিবার। যে গ্রামকে বুকে করে বয়ে বেরিয়েছিলেন, সেই গ্রামেই ক্রমশ পিছিয়ে পড়তে লাগলেন বিদ্যাসাগর। বিস্তর অর্থ উপার্জন করেছিলেন, সেইসব অকাতরে বিলিয়েও দিয়েছেন। থাকতেন অত্যন্ত সাধারণ পোশাকে। সাধারণ লোকে ভাবত, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের না জানি কত দামি গাড়ি, বাড়ি, জামাকাপড় আছে। কিন্তু তিনি সামনে আসলে অবাক হয়ে যেত সবাই।
হায় রে জীবন! এত কিছু করেও শেষ জীবনে কী প্রতিদান পেলেন তিনি? ছেলে নারায়ণচন্দ্রের সঙ্গে এক বিধবা রমণীর বিয়ে দিয়ে সমাজে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। ছেলে যে মুখ উজ্জ্বল করেছে এই কথাও বলেছেন অনেক সময়। কিন্তু পরে সেই নারায়ণচন্দ্রের কাছ থেকেই পেলেন একের পর এক যন্ত্রণা। শাসন করার অনেক চেষ্টা করেছেন; কিন্তু নিজের স্ত্রী দিনময়ী দেবী, বাবা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও মা ভগবতী দেবীর জন্য সেটা পারেননি। তা নিয়ে ক্ষোভও ছিল তাঁর। শেষ পর্যন্ত নিজের ছেলের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন বিদ্যাসাগর। নারায়ণের সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল কলকাতায়, নিজের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের আগে। তখন কী মনে হয়েছিল তাঁর?
আরও পড়ুন
অর্ধশতাব্দী আগেই বিলেত জয়; ভারতীয় রান্নায় লন্ডনকে মজিয়েছিল ‘দ্য হালাল’
সমাজ যাতে সমস্ত দিক থেকে কুসংস্কারমুক্ত হয়, শিক্ষার আলো যাতে সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে সেজন্য তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন। বীরসিংহ গ্রামের জন্য হাসপাতাল, স্কুল বানিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন বিদ্যাসাগর একা হয়ে যাচ্ছিলেন। লড়াইয়ের রাস্তায় তাঁর আপনজনেরা ছিল না। সম্পর্কের শেষ পেরেকটা পোঁতা হয় ১৮৬৯ সালে (বাংলায় ১২৭৬ সাল)। অদ্ভুত ব্যাপার, এর সূত্র তৈরি হয়েছিল বিধবা বিবাহের হাত ধরেই। ক্ষীরপাইয়ের বাসিন্দা মুচিরাম বন্দ্যোপাধ্যায়, মনোমোহিনী নামের এক বিধবা নারীকে বিয়ে করার জন্য বিদ্যাসাগরকে চিঠি লেখেন। বিধবা বিবাহ আন্দোলনে তখন খানিক পিছনেই পড়ে গেছেন বিদ্যাসাগর। তবুও তিনি এই বিবাহ অনুষ্ঠানে যেতে রাজি হলেন। ক্ষীরপাইয়ে পৌঁছনোর পর সেখানকার হালদারমশাই এবং আরও কয়েকজন গ্রামবাসী তাঁর কাছে আসেন। এসেই অনুরোধ জানান, যাতে এই অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত না থাকেন। এরকম কাজ বিদ্যাসাগর প্রধানত করতেন না কখনও। কিন্তু তখন তাঁর নিজের শরীর-মনও ভালো নেই; তার ওপর গ্রামের এই লোকেরাই আগে মুচিরামের বিয়েকে সমর্থন জানিয়েছিল। এখন তাঁদের নানাবিধ কারণ শুনে বিদ্যাসাগর ঠিক করলেন অনুষ্ঠানে যাবেন না। ঠিক কেন গেলেন না, সেই কারণ সঠিক করে জানা যায় না। তবে মুচিরাম-মনোমোহিনীর বিয়ে ঠিকই হয়েছিল। সেই বিয়ের দায়িত্ব নিয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরেরই ভাই শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন।
এই ঘটনাই বিবাদ আরও বাড়িয়ে দিল। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, যিনি বিধবা বিবাহ নিয়ে এত লড়লেন, তিনিই কিনা এলেন না এই অনুষ্ঠানে! বীরসিংহ যেন একটু ক্ষুণ্ণই হল বিদ্যাসাগরের প্রতি। বিবাদ এড়াল না পরিবারেও। শম্ভুচন্দ্র সরাসরি দাদাকে ‘পশ্চাৎপদতা ও কাপুরুষতার পরিচয়’ বলে আক্রমণ করেন। বিদ্যাসাগর এতটা আশা করেননি। ভেতরে ভেতরে বুঝেছিলেন, এটাই শেষ। এখানেই থেমে যাওয়া উচিত পথ চলা। এক রাত্রি কোনো খাবার খাননি তিনি। পরেরদিন সকালে উঠেই ঠিক করলেন, এই বীরসিংহ গ্রাম, তাঁর পরিবার— সবাইকে ছেড়ে চিরকালের জন্য চলে যাবেন। আর কখনও এখানে পা দেবেন না। যাওয়ার আগে গ্রামবাসীদের শুধু একটাই কথা বললেন, ‘তোমরা আমাকে দেশত্যাগী করাইলে!’…
আরও পড়ুন
বিরোধীরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ, ‘গণতান্ত্রিক’ পথেই জয় এনেছিলেন বিদ্যাসাগর
বিদ্যাসাগরের কাহিনি বললেই মনে পড়ে তাঁর বাবা-মায়ের প্রতি অসম্ভব ভক্তির কথা। মা ভগবতী দেবীকে ছেড়ে যাওয়ার কথা তিনি ভাবতেই পারতেন না। সেখানে সবার কাছ থেকে বিদায় নিলেন। যাওয়ার আগে মা-কে লিখলেন, “… ইদানীং আমার মনের ও শরীরের যেরূপ অবস্থা ঘটিয়াছে তাহাতে পুর্ব্বের মত নানা বিষয় সংসৃষ্ট থাকিলে অধিক দিন বাঁচিব এরূপ বোধ হয় না। এজন্য স্থির করিয়াছি, যতদূর পারি নিশ্চিন্ত হইয়া জীবনের অবশিষ্ট ভাগ নিভৃত ভাবে অতিবাহিত করিব। এক্ষণে আপনার শ্রীচরণে এ জন্মের মত বিদায় লইতেছি…”। কতটা অভিমান, কতটা কষ্ট পেলে এমন সিদ্ধান্তে আসতে পারেন তিনি! এমনকি, এই চিঠিতেই নিজেকে ‘অপরাধী’ও বলেছেন। তবে নিজের দায়িত্ব থেকে সরে আসেননি তিনি। যতদিন মা-বাবা বেঁচে আছেন, ততদিন পুত্র হিসেবে তাঁদের কাছে টাকা পাঠিয়ে যাবেন। “… যতদিন শরীর ধারণ করিবেন কোন কারণে তাঁহার ব্যাতিক্রম ঘটিবেক না।”
শুধু মা’কেই নয়, নিজের স্ত্রী দিনময়ী দেবীকেও চিঠি লিখে বিদায় বার্তা জানিয়েছিলেন তিনি। “… এক্ষণে তোমার নিকটে এ জন্মের মত বিদায় লইতেছি এবং বিনয় বাক্যে প্রার্থনা করিতেছি যদি কখন কোন দোষ বা অসন্তোষের কার্য্য করিয়া থাকি, দয়া করিয়া আমাকে ক্ষমা করিবে। তোমার পুত্র উপযুক্ত হইয়াছেন, অতঃপর তিনি তোমাদের রক্ষণাবেক্ষণ করিবেন।” এখানেও পুত্রের প্রতি তাঁর হতাশা ও বিরাগভাজন হওয়ার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। ততদিনে অবশ্য নারায়ণচন্দ্রের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন তিনি। একে একে বাবা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, তিন ভাই দীনবন্ধু, শম্ভুচন্দ্র ও ঈশানচন্দ্রকেও চিঠি লিখলেন। ‘সাংসারিক বিষয়ে’ তাঁর মতো ‘হতভাগ্য’ যে আর নেই, সেই কথাও জানিয়ে দিলেন তিনি। শেষ পর্যায়ও সমস্ত দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করে গ্রাম ছাড়লেন বিদ্যাসাগর। সেই যে বেরোলেন, আর ফিরলেন না কখনও। বীরসিংহ হারাল তাঁর উজ্জ্বল রত্নকে, নিজেরই দোষে। বরং নতুন জীবন পেল কর্মাটাড়। সারাজীবন বীরসিংহের কষ্ট কি ছিল না ঈশ্বরচন্দ্রের? অভিমানেই তো চলে গেলেন শেষ পর্যন্ত। আমরাও কি তাঁকে বুঝতে পেরেছি…
আরও পড়ুন
‘অতি গুরুতর মহাপাপ’ করেছেন বিদ্যাসাগর; কেন এমন লিখেছিলেন তাঁর দৌহিত্রী?
তথ্যসূত্র-
১) ‘বিদ্যাসাগর’/ চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়
২) ‘বিদ্যাসাগর নন, কর্মাটাড়ের ঈশ্বর’, জয়ন্ত সিংহ মহাপাত্র, আনন্দবাজার পত্রিকা
৩) ‘নীলকণ্ঠ বিদ্যাসাগর’, আনন্দবাজার পত্রিকা
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
বিদ্যাসাগরের জন্মদিনেই পালিত হোক শিক্ষক দিবস, আবেদন নেটিজেনদের