বিশ্বে মাইক্রোবায়োলজির প্রথম পেটেন্ট তাঁর নামে, নীরবেই চলে গেলেন বাঙালি গবেষক আনন্দমোহন

মানবসভ্যতার কাছে এখনো একটা রহস্য, ক্যানসার। কর্কটরোগের প্রতিরোধক ওষুধ তৈরিতেই গবেষণারত পৃথিবীর তাবড় নানান সংস্থা। তবে এই মারণ রোগ নির্মূল করার অভিনব হদিশ দিয়েছিলেন বাঙালি গবেষক ‘প্রফেসার সিউডোমোনাস’। নামটা শুনলেই মনে হবে প্রফেসর শঙ্কুর গল্পের কোনো চরিত্র হয়তো। তাঁর গবেষণা এবং আবিষ্কারের ধরণও কল্পবিজ্ঞানের গল্পের মতোই আশ্চর্যজনক। সকলকে অবাক করেই ক্যানসার প্রতিরোধে ব্যাকটেরিয়ার ব্যবহার করেন তিনি। ‘প্রফেসার সিউডোমোনাস’, এই ছদ্মনামের পিছনে লুকিয়ে থাকা মানুষটি আর কেউ নন, ডঃ আনন্দমোহন চক্রবর্তী। তবে আজীবন তাঁর কাজের নিরিখে খানিকটা আড়ালেই থাকলেন তিনি। সেই একান্ততা, নিস্তব্ধতার মধ্যে দিয়েই গত ১০ জুলাই না-ফেরার জগতে পাড়ি দিলেন প্রফেসার সিউডোমোনাস। বয়স হয়েছিল ৮২ বছর।

১৯৩৮ সালে সাঁইথিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন ডঃ আনন্দ মোহন চক্রবর্তী। বীরভূমের এই ছোট্ট মফস্বলেই বেড়ে ওঠা তাঁর। পরবর্তীকালে স্নাতকস্তরে পড়াশোনা করেছেন বেলুড়ের রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দিরে। স্নাতকোত্তর কলকাতার সেন্টজেভিয়ার্স কলেজ থেকে। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত ছিলেন মাইক্রোবায়োলজি নিয়ে। ১৯৬৫ সালে সম্পূর্ণ করেন পিএইচডি। তারপরই তাঁর বিদেশযাত্রা। ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক এবং অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হন তিনি। জীবনের শেষদিন অবধি শিকাগোর এই বিশ্ববিদ্যালয়েই বিজ্ঞান এবং অধ্যাপনার সঙ্গেই জড়িয়ে ছিল তাঁর যাপন।

অণুজীববিদ্যা বা মাইক্রোবায়োলজিই ছিল তাঁর গবেষণার বিষয়। কিন্তু তারপরেও কর্কটরোগের রহস্য সমাধানে করেছিলেন তিনি। যা অবাক করার মতই। নিজেও মজার ছলেই বলেছিলেন, তাঁর গবেষণায় ক্যানসার যে একটা অধ্যায় হয়ে যাবে তা নিজেও ভাবেননি কোনোদিন। বেশ কিছু অণুজীব নিয়েই গবেষণা করছিলেন তিনি। এই গবেষণার মধ্যে থেকেই সামনে আসে সিউডোমোনাস এরুজিনোসা নামে একটি ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে উপস্থিত থাকে অ্যাজুরিন নামক একটি প্রোটিন। যার মাধ্যমে এই এককোষী অণুজীব ক্যানসারের প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে নিজেদের দেহেই। ব্যাকটেরিয়ার চরিত্র লক্ষ্য করেই গবেষণার মোড় ঘুরিয়ে দেন প্রফেসার আনন্দমোহন চক্রবর্তী। প্রথমে ইঁদুরের দেহে এই ব্যাকটেরিয়ার প্রয়োগে সাফল্য আসে। পাশাপাশি তিনি সামনে আনেন এই ব্যাকটেরিয়ার কোনোরকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। কেবলমাত্র কর্কটরোগাক্রান্ত কোষগুলিতেই কাজ করে এই ব্যাকটেরিয়া। মানবদেহেও এই ব্যাকটেরিয়া প্রয়োগের প্রথম পর্যায়ের ক্লিনিকাল ট্রায়াল সফল হয়েছিল। প্রস্তুতি চলছে পরবর্তী পর্যায়ের। কিন্তু নিজের গবেষণার চূড়ান্ত সাফল্য দেখে যেতে পারলেন না প্রফেসর সিউডোমোনাস।

তবে জীবনদায়ী এই ব্যাকটেরিয়া আবিষ্কারের বহু আগেই তিনি পরিচিত হয়েছিলেন ‘প্রফেসর সিউডোমোনাস’ নামে। সম্মানিত হয়েছিলেন বিশ্বের দরবারে। সেখানেও তাঁর লড়াই যেন কোনো গল্পেরই অংশ। বহু আগে থেকেই বিজ্ঞানীদের কাছে পরিচিত ছিল উডোমোনাস ব্যাকটেরিয়ার অস্তিত্ব। এই ব্যকটেরিয়ার মূল ক্ষমতা হল তৈল-ভক্ষণ। শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহৃত হত এই অয়েল মেটাবলিক ব্যাকটেরিয়া। কিন্তু খুব একটা লাভজনক ছিল না তা। তিনি প্রথম সিউডোমোনাস সিউডোমনাস কোষের চারটি ভিন্ন ভিন্ন সুত্র থেকে আসা প্লাসমিডবাহী জিন ট্রান্সফার করে একটা ইঞ্জিনিয়ার্ড ব্যাকটেরিয়া নিজে বানিয়ে ফেলেন। যার নাম দেন সিউডোমোনাস পিউটিডা। তাঁর এই জিনগত ক্রস-লিঙ্কিংয়ের ফলে বহুগুণ বেড়ে গেল ব্যাকটেরিয়ার তৈল-ভক্ষণকারী ক্ষমতা। এই ব্যাকটেরিয়া আজও বহুল-ব্যবহৃত মহাসাগরে ভাসমান দূষণকারী খনিজতেলের বিয়োজনে। কিন্তু এই আবিষ্কারের পেটেন্ট নেওয়ার জন্যই তাঁকে দ্বারস্থ হতে হয়েছিল আদালতে। তৎকালীন আমেরিকার পেটেন্ট অফিসের কমিশনার সিডনিই ডায়মন্ড আপত্তি জানিয়েছিলেন। দাবি করেছিলেন, জীবিত কোনো জীবের জন্য পেটেন্ট পাওয়া সম্ভব নয়। তবে শেষ অবধি যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালতের রায় গিয়েছিল প্রফেসার আনন্দমোহনের পক্ষেই। পৃথিবীর প্রথম অণুজীব হিসাবে পেটেন্ট লিখিত হয়েছিল তাঁর নামেই। বিশ্বের কাছে তিনি পরিচিত হয়েছিলেন প্রফেসর সিউডোমোনাস হিসাবে।

আরও পড়ুন
চলে গেলেন বাংলাদেশের 'প্লেব্যাক সম্রাট' এন্ড্রু কিশোর, শোকাহত অসংখ্য অনুরাগী

ছিলেন রাষ্ট্রপুঞ্জের পরামর্শদাতা। ন্যাটোর-ও সদস্য ছিলেন এই বাঙালি গবেষক। এছাড়াও আইনস্টাইন ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্সের স্বাস্থ্য বিভাগের অন্যতম পরিচালক-সদস্য ছিলেন তিনি। ২০০৭ সালে ভারত সরকার ‘পদ্মশ্রী’ খেতাবে ভূষিত করে তাঁকে। এককথায় মাইক্রো-বায়োলজির জগতে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। 

কর্মসূত্রে শিকাগোয় থাকলেও ভারতে বার বার ছুটে এসেছেন বাংলার এই ভূমিপুত্র। কলকাতা, গুজরাট-সহ ভারতের বিভিন্নপ্রান্তে ক্যানসার গবেষণার পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন তিনি। কিন্তু এসবের পরও জন্মভূমিতে অনালোচিতই রয়ে গেলেন বাংলার এই গবেষক। কেবলমাত্র গবেষণার মূল্যবান তথ্যগুলি দেশের বিজ্ঞানচর্চার জন্য সযত্নে রেখে দিয়ে নীরবেই চলে গেলেন আধুনিক অণুজীববিদ্যার পিতৃ-চরিত্র...    

আরও পড়ুন
চলে গেলেন বলিউডের 'মাস্টারজি', সরোজ খানের মৃত্যুতে শোকের ছায়া

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More