বাঙালির পাশে দাঁড়াতে যে ‘প্রেমপত্র’ চুরি করেছিলেন বেলজিয়ামের তরুণ

রাত তখন বেশ অনেকটা। ব্রাসেলসের ফাইন আর্ট মিউজিয়ামের আলোগুলো নিভে গেছে। কিছুক্ষণ আগেও যে হলঘরে দর্শকদের আনাগোনা ছিল, এখন তা শূন্য। সম্পূর্ণ শূন্য কি? কারণ একটু একটু করে স্পষ্ট হচ্ছে পায়ের আওয়াজ। সতর্ক ভঙ্গিতে আওয়াজটা এগিয়ে যাচ্ছে দেওয়ালে টাঙানো একটি ছবির দিকে। কিছুক্ষণ পর ছবিটি নিয়েই সে লাফ দিল মিউজিয়ামের জানলা দিয়ে। পরেরদিন সমস্ত খবরের কাগজে শিরোনাম, ‘মহামূল্য ছবি খোয়া গেছে মিউজিয়াম থেকে’। আর যিনি চুরি করেছেন, তাঁর লক্ষ্য ছবিটি বিক্রি করার। এইসবই যে তিনি করেছেন ভালোবাসার জন্য; কয়েকশো কিলোমিটার দূরে লড়াই করা বাংলাদেশের জন্য…

গল্পটা শুরু হয় ১৯৭১ সালে। বাংলাদেশের সংগ্রামের খবর তখন গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁদের ভাষার অধিকার, সংস্কৃতির অধিকার, সর্বোপরি স্বাধীনতার অধিকারের খবর প্রতিটা দৈনিকের পাতায়। একের পর এক মানুষ মারা যাচ্ছে সেখানে। পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের অত্যাচার, নিপীড়ন, শোষণ নেমে এসেছিল বাংলাদেশের ছেলে-মেয়ে-শিশু-বৃদ্ধের ওপর। প্রতিবাদ করলেই মৃত্যু! একের পর এক মেয়েকে ধর্ষিতা হতে হচ্ছে। আর সেইসব ছবি ধরা পড়ছে দেশবিদেশের টিভির পর্দায়। যত জোরালো হচ্ছে মুক্তির সংগ্রাম, ততই বেয়নেটে শান দিচ্ছে পাকিস্তানি সেনা। 

এই পুরো ছবিটাই একদিন উঠে এল মারিও রয়ম্যান্স নামের বছর একুশের এক ছেলের সামনে। বেলজিয়ামে বসেই একদিন দেখলেন বাংলাদেশের সংগ্রামের দৃশ্য। শিউরে উঠলেন তিনি! এ কি অবস্থা সেখানকার মানুষের? এঁদের জন্য কি কিছুই করা যায় না? এঁদের প্রতিবাদ, সংগ্রাম কি বিফলে যাবে? এতদূরে থেকে তিনিই বা কী করে তাঁদের পাশে গিয়ে দাঁড়াবেন… নানা চিন্তা ঘুরতে লাগল মারিও’র মাথায়। এদিকে খবরে এও শোনা যাচ্ছে, বিশ্বের নানা জায়গা থেকে ত্রাণ পৌঁছে যাচ্ছে বাংলাদেশে। অনেক নামী মানুষরাও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। 

কিন্তু মারিও রয়ম্যান্স কতটুকুই বা অর্থসাহায্য করতে পারবেন? তিনি বেলজিয়ামের হোটেল সোয়েটেওয়ে’র সামান্য একজন ওয়েটার। বড়ো অর্থসাহায্য না পাঠালে তো ওই মানুষগুলোও কিছু করতে পারবে না। না, এভাবে হবে না। মারিও ঠিক করলেন, দরকার হলে অসৎ উপায় বেছে নেবেন তিনি। খুন বা সন্ত্রাস করবেন না; করবেন চুরি। তারপর সেখান থেকেই টাকা জোগাড় করে পাঠিয়ে দেবেন বাংলাদেশের ওই মানুষগুলোর কাছে। 

আরও পড়ুন
বাঙালিদের কাছে পৌঁছে দেবেন ওষুধ; পাক বিমান অপহরণের চেষ্টা ফরাসি যুবকের

সবই ঠিক হল; কিন্তু চুরি করবেনটা কী? ওয়েটারের কাজ করার পাশাপাশি আরও একটি দিকে মারিও’র বিশেষ উৎসাহ ছিল। সেটি চিত্রশিল্প। আঁকতে যেমন ভালোবাসতেন, তেমনই দেশ-বিদেশের শিল্পীর ছবি দেখতেও ভালোবাসতেন। ওই মুহূর্তে ব্রাসেলসের ফাইন আর্ট মিউজিয়ামে একটি বিশেষ প্রদর্শনী চলছিল। প্রাচীন সমস্ত ছবির সম্ভার হাজির হয়েছিল সেখানে। আর তার মধ্যেই ছিল সতেরশো শতকের চিত্রশিল্পী ইয়ান ভারমিয়ারের ‘দ্য লাভ লেটার’ চিত্রটি। তখনকার হিসেবে যার দাম ছিল প্রায় পাঁচ মিলিয়ন ডলার! চিত্রপ্রেমী মারিও রয়ম্যান্স লক্ষ্য ঠিক করে নিলেন। এই ‘প্রেমপত্র’ই চুরি করবেন তিনি, তারপর বাকি কাজ চালাবেন… 

পরিকল্পনা মতো ব্রাসেলস ফাইন আর্ট মিউজিয়ামে পৌঁছে গেলেন মারিও রয়ম্যান্স। ১৯৭১ সাল, ২৩ সেপ্টেম্বর। ঘুরতে ঘুরতে নজরে পড়ল ‘দ্য লাভ লেটার’। ব্যস, জায়গা জেনে গেছেন তিনি। এবার শুধু সুযোগ বুঝে লুকিয়ে পড়তে হবে। সেইমতো মিউজিয়ামের হলঘরের এক কোণে থাকা ইলেকট্রিকাল বক্সের ভেতর ঢুকে পড়লেন তিনি। কেউ খেয়ালও করলেন না। সিসিটিভিরও যুগ নেই তখন। এবার অপেক্ষা রাত হওয়ার। 

আরও পড়ুন
চুরির টাকায় দরিদ্রদের সাহায্য! হ্যাকার, নাকি হালের ‘রবিনহুড’?

একসময় রাত হল; এবং মিউজিয়ামের ঝাঁপও পড়ল। হলঘরে একা মারিও রয়ম্যান্স। এবার বেরোলেন ইলেকট্রিক্যাল বক্স থেকে। গুটিগুটি পায়ে সামনে এসে দাঁড়ালেন ইয়ান ভারমিয়ারের ছবিটির সামনে। দেওয়াল থেকে এক ঝটকায় ছবিটি তুলে এগিয়ে গেলেন জানলার দিকে। এ কি! এ তো আরেক মুশকিল! ছবির ফ্রেম যে সাংঘাতিক বড়ো। জানলা দিয়ে গলছে না। সঙ্গে ছিল আলু কাটার ছুরি। প্রায় বাধ্য হয়েই ফ্রেম থেকে কেটে বের করে আনলেন ‘দ্য লাভ লেটার’ ছবিটি। ভালো করে গুটিয়ে পকেটে ভরে নিলেন; তারপর দিলেন এক লাফ। ছবিটিরও একটু ক্ষতি হল বটে, কিন্তু কিছু তো করার নেই… 

সোয়েটেওয়ে’র হোটেলের নিজের ঘরে এসে ছবিটিকে লুকিয়ে রাখেন। পরেরদিনই সমস্ত কাগজে ছবিচুরির খবর প্রকাশ্যে এসে যায়। স্বাভাবিকভাবেই সমস্ত জায়গায় নিরাপত্তা ও খানাতল্লাশ বেড়ে যায়। এমন অবস্থায় ছবিটিকে হোটেলের পেছনে মাটি খুঁড়ে চাপা দিয়ে দেন মারিও। কিন্তু কয়েকদিন পর বৃষ্টি শুরু হলে আবার ঘরে নিয়ে আসেন। এর কয়েকদিন পরেই ব্রাসেলসের এক সাংবাদিকের কাছে একটি ফোন আসে। ওপারে থাকা মানুষটি নিজেকে বলেন ‘লিমবাগের থিল’ হিসেবে। বাস্তবিকই, লোকটি ছিলেন স্বয়ং মারিও রয়ম্যান্স। লিমবাগে জন্ম তাঁর, আর ‘থিল’ আদতে একটি লোকচরিত্র; অনেকটা রবিনহুডের মতো। ফোনেই তিনি সাংবাদিককে জানান, হারিয়ে যাওয়া ‘দ্য লাভ লেটার’ তাঁর কাছেই আছে। যদি ছবিটি পেতে চান, তবে চার মিলিয়ন মার্কিন ডলার দিতে হবে। 

আরও পড়ুন
জন্মদিনেই চুরি, মিউজিয়াম থেকে উধাও ভ্যান গঘের আঁকা ছবি

অবশ্য একই সঙ্গে মারিও জানান তাঁর উদ্দেশ্যের কথা। এর একটি টাকাও তিনি নিজের জন্য ব্যবহার করবেন না। বরং এগুলো দেওয়া হবে এমন একটি চার্চকে, যারা টাকাগুলো পাঠিয়ে দেবে বাংলাদেশের নিপীড়িত মানুষগুলোর কাছে। সাংবাদিক এসে ছবিও তুলে নিয়ে যান সমস্ত কিছুর। প্রকাশ্যে আসার পর রীতিমতো আলোড়ন শুরু হয়ে যায় বেলজিয়াম জুড়ে। ছবি চুরি করেছে যে, সে-ই কিনা বলছে টাকা পাঠাবে বাংলাদেশের মানুষদের কাছে! ইতিমধ্যে আরও অনেক মিডিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করেন মারিও রয়ম্যান্স। পুলিশ একদিকে তাঁকে খুঁজছে; অন্যদিকে জনগণের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়ছে। যেন সত্যিকারের রবিনহুড! ওঁকে কিছুতেই আটক করা যাবে না। শ্লোগানে শ্লোগানে ভরে উঠল ব্রাসেলস, বেলজিয়ামের রাস্তা। 

একটা সময় ধরা পড়েন মারিও রয়ম্যান্স। তিনি অন্যায় করেছিলেন বটে, কিন্তু সেটা তো নিজের জন্য নয়। বরং সেই সমস্ত মানুষের কথা ভেবেছিলেন, যারা তখন স্বাধীনতার জন্য নিজের সর্বস্ব খুইয়ে ফেলেছে। কয়েকশো কিমি দূরে থাকা ব্রাসেলসের এক তরুণ ওয়েটারের মানবতা গোটা বেলজিয়ামে নজির সৃষ্টি করল। কিন্তু মারিও রয়ম্যান্স কি ঠিকমতো শুশ্রূষা পেলেন? গ্রেফতারের পর আদালতের বিচারে তাঁর দুই বছর কারাদণ্ড হয়। সেই সাজা অবশ্য কমে এসেছিল ছয় মাসে। কিন্তু ওই ছয় মাসই বদলে দেয় মারিওকে। তিনি যেন নিজেকে ঠিক চিনতে পারলেন না আর। বাংলাদেশ যে স্বাধীনতা পেয়েছে, সেই খবর শুনেছিলেন কি? জানা নেই। শুনলেও, তিনি আর তখন নিজের মধ্যে ছিলেন না। মানসিক রোগ তাঁকে ছিঁড়ে ফেলেছে একদম। মাত্র ২৯ বছর বয়সে তিনি মারা যান। তাঁর দাবি করা টাকা বাংলাদেশের ওই মানুষগুলোর কাছে পৌঁছেছিল কিনা, জানা যায় না। মারিও রয়ম্যান্স কি সত্যিই অপরাধী ছিলেন? অপরাধের সংজ্ঞাটি ঠিক কী? এই প্রশ্নগুলো আরও একবার তুলে দেন তিনি। আর আড়ালে ঘুমিয়ে থাকেন বাংলাদেশের এক ভুলে যাওয়া ‘বন্ধু’, এক অন্য ‘রবিনহুড’। 

Powered by Froala Editor

More From Author See More